কীভাবে পরিযায়ী পাখিরা এত নির্ভুলতার সাথে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে গবেষণা কি বলছে?

উত্তরাপথঃ প্রতিবারের মত এবারও হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি দেখা গেল রায়গঞ্জের কুলিক পক্ষী নিবাসে। পরিসংখ্যান বলছে প্রতিবছর এই পক্ষীনিবাসে প্রায় ৯০,০০০ থেকে ১০০,০০০ পরিযায়ী পাখি আসে। এমন ছোট্ট একটি পাখি , সে কীভাবে হাজার হাজার মাইল উড়ে আমাদের দেশে আসে, তা সত্যিই এক বিস্ময়! জানা গেল পরিযায়ী পাখিরা প্রায় হাজারেরও বেশী মাইল পথ অতিক্রম করে আমাদের দেশে আসে শীতকালের পর তারা আবার নিজেদের স্থানে ফিরে যায়।

এই পাখিগুলি শীতপ্রধান এলাকা থেকে খাবারের সন্ধানে আমাদের দেশে দলে দলে আসে। এ দেশে প্রায় ৩০০ বেশী প্রজাতির পরিযায়ী পাখি শীতকালে আসে। এই পাখিগুলি প্রতি বছর শীতের কঠোর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে এবং খাবার এবং বংশবৃদ্ধির জন্য আরও অতিথিপরায়ণ পরিবেশ খুঁজে পেতে বিশাল দূরত্ব ভ্রমণ করে। কিন্তু কীভাবে এই পাখিরা তাদের পথ চেনে এবং এত নির্ভুলতার সাথে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে? এই প্রশ্নটি কয়েক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করেছে, এবং সাম্প্রতিক গবেষণা এই ভ্রমণকারী পাখিদের অসাধারণ ক্ষমতার উপর নতুন আলো ফেলেছে।

সাম্প্রতিক গবেষণা  অনুসারে পরিযায়ী পাখিদের ভ্রমণের সবচেয়ে ভালোভাবে নথিভুক্ত প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে একটি হল পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর তাদের নির্ভরতা। গবেষণায় দেখা গেছে যে পাখিদের একটি বিশেষ সংবেদনশীল সিস্টেম রয়েছে যা তাদের পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সনাক্ত করতে এবং ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।পরিযায়ী পাখিরা  তাদের ভ্রমণকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য এটিকে এক ধরণের প্রাকৃতিক কম্পাস হিসাবে ব্যবহার করে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বোঝার এই ক্ষমতা পাখির চোখে অবস্থিত বলে মনে করা হয়, বিশেষত ক্রিপ্টোক্রোম নামক বিশেষ কোষ যা আলো এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রতি সংবেদনশীল।

তাদের চৌম্বক সংবেদন ক্ষমতা ছাড়াও, পরিযায়ী পাখিরা তাদের পথ দেখানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের নৌ-সংকেত ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক পাখির প্রজাতিকে স্থানান্তরের সময় নিজেদের অভিমুখী করতে সূর্য এবং তারার অবস্থানের মতো স্বর্গীয় সংকেত ব্যবহার করতে দেখা গেছে। পাখিরা প্রায়শই “সূর্য কম্পাস ওরিয়েন্টেশন” নামে পরিচিত একটি আচরণ করে, যেখানে তারা আকাশে সূর্যের অবস্থানকে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করে তাদের যাত্রার সময় একটি সরল পথ বজায় রাখার জন্য।

পরিযায়ী পাখিদের দ্বারা ব্যবহৃত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ন্যাভিগেশনাল কিউ হল তাদের মাইগ্রেশন রুটের ভৌগলিক ল্যান্ডমার্ক চিনতে এবং মনে রাখার ক্ষমতা। নদী, পর্বত এবং উপকূলরেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কগুলি মনে রাখার মাধ্যমে, পাখিরা অন্যান্য সংবেদনশীল সংকেতের অনুপস্থিতিতেও তাদের পথে চলাচল করতে সক্ষম হয়। তাদের পরিবেশের মানসিক মানচিত্র তৈরি করার এই ক্ষমতা পাখিদের জটিল ন্যাভিগেশনাল সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাধা এড়াতে বা পথের ধারে খাদ্য ও আশ্রয় খুঁজে পেতে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের রুট সামঞ্জস্য করতে দেয়।

ট্র্যাকিং প্রযুক্তির সাম্প্রতিক অগ্রগতি বিজ্ঞানীদের অভূতপূর্ব বিস্তারিতভাবে পরিযায়ী পাখির নেভিগেশন অধ্যয়ন করতে সক্ষম করেছে। জিপিএস ট্র্যাকিং এবং স্যাটেলাইট টেলিমেট্রির মতো কৌশলগুলি ব্যবহার করে, গবেষকরা স্থানান্তরিত হওয়ার সময় পৃথক পাখিদের উড়ানের পথ এবং আচরণগুলি নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন, যা এই অসাধারণ প্রাণীদের পথ খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহৃত কৌশল এবং প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

বলা হয় একটি পরিযায়ী পাখি জানে সে কত দিন কত দূর উড়ে কোন জায়গায় গিয়ে খাবার পাবে। সেই অনুপাতে তারা খাবার খায় বা শরীরে চর্বি সঞ্চয় করে। এখন যদি একটি পাখি সাইবেরিয়া থেকে ওড়া শুরু করে একসঙ্গে বিভিন্ন পথ অতিক্রমের পর যখন পাখিটি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে আসে খাবারের সন্ধানে এবং নেমে দেখে তার সেই গন্তব্যটি আর নেই বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; তাহলে ওই পাখির মৃত্যু হয়। পাখিরা দুর্বল হয়ে পড়ে বা আর উড়তে পারে না। তাই পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ খুবই জরুরি।

বর্তমান পৃথিবীতে পরিযায়ী পাখিরাই সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে আছে। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত দল বেঁধে চলাচল করে, খাবার খোঁজে এবং বিশ্রাম নেয়। তাই পাখি শিকারিরা সহজেই তাদের শিকার করতে পারে। এ ছাড়া আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণেও তারা দিনে দিনে সমস্যার মুখে পড়ছে।আমাদের দেশে শীতে যেসব পাখি আসে, সেগুলো আমাদেরই পাখি। এসব পাখির টিকে থাকার জন্য আমাদের আবাসস্থল দরকার। তাই তাদের অতিথি পাখি বলে অবহেলা না করে তাদের আবাসস্থলগুলির সংরক্ষণ জরুরী।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ধানের সাধ ভক্ষণ : জিহুড়

ড.  নিমাইকৃষ্ণ মাহাত: আশ্বিন সংক্রান্তিতে কৃষক সমাজের মধ্যে জিহুড় পার্বণ পালিত হয়। কৃষক সাধারণের মধ্যে জিহুড় পার্বণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জিহুড় অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তির সময় বহাল জমিতে লাগানো ধান বা বড়ান ধানে থোড় আসতে শুরু করে। সুতরাং ধান গাছ গর্ভাবস্থায় থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় নানা ধরনের আচার-সংস্কার পালন করা হয়। এই সংস্কারগুলির অন্যতম হলো " ন' মাসি " অর্থাৎ গর্ভাবস্থার নবম মাসে যে আচার -অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এর কিছুদিন পরেই সন্তানজন্মগ্রহণ করে। মানব- সমাজের গর্ভাবস্থাজনিত এই ধরনের আচার সংস্কারের সঙ্গে ধান গাছের গর্ভাবস্থার কারণে পালনীয় অনুষ্ঠান জিহুড়ের সাদৃশ্য থাকে দেখা যায়। সেই জন্য অনেকে জিহুড় অনুষ্ঠানকে ধান গাছের 'সাধভক্ষণ'  বলে থাকেন। জিহুড়-এ ধান গাছ .....বিস্তারিত পড়ুন

একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) স্পেন সফরে

উত্তরাপথঃ  একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পেনে রয়েছেন। জানা যাচ্ছে, স্পেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বৈঠক হবে ফুটবল নিয়ে। ১৪ সেপ্টেম্বর, মাদ্রিদে লা লিগার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদলের বৈঠক। বাংলা ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে সরকারের সঙ্গে কোনও বিশেষ চুক্তি হতে পারে লা লিগার । এই বৈঠকে তাঁর সঙ্গে থাকবেন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিংয়ের ক্লাবকর্তারাও। এছাড়াও থাকার কথা  সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও।যদিও তিনি এই মুহূর্তে লন্ডনে রয়েছেন লন্ডনে,সেখান থেকেই ১৪ তারিখ সরাসরি মাদ্রিদ পৌঁছবেন বলে খবর।এরপর স্পেনে মমতার লক্ষ্য রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ টানা। রাজ্যে বিদেশি লগ্নি বাড়াতে তিনি সঙ্গে বড় প্রতিনিধিদল নিয়ে স্পেনে গিয়েছেন।প্রতিনিধিদলে রয়েছেন ময়দানের তিন ফুটবল ক্লাবের কর্তা, বই প্রকাশকদের একটি দল। .....বিস্তারিত পড়ুন

ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো ও বিশ্ব মঞ্চে ভারতের লোকনৃত্য

গার্গী আগরওয়ালা মাহাতোঃ আমাদের চারিদিকে বিশ্ব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে,পরিবর্তিত হচ্ছে শিল্প সাধনার প্রকৃতি। এই পরিবর্তিত শিল্প সাধনার যুগে আমাদের সেই সমস্ত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং সম্মান করা অপরিহার্য যারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এমনই একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো। নেপাল মাহাতো, যার ছৌনৃত্যের জগতে  দেশে ও বিদেশে অতুলনীয় অবদান তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী´এনে দিয়েছে। নেপাল মাহতোর জন্ম ১৭ জুন ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার থানার আদাবনা নামে একটি ছোট গ্রামে। তার পিতা স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ মাহাতো ও মাতা তুষ্ট মাহাতো। .....বিস্তারিত পড়ুন

টাইফুন ইউন-ইউং এর আজ জাপানের টোকাই অঞ্চলে প্রত্যাশিত ল্যান্ডফল

উত্তরাপথঃ জাপানের জনগণ টাইফুন নং ১৩ যা ইউন-ইউং নামে পরিচিত যা শুক্রবার বিকেলের দিকে টোকাই অঞ্চলে ল্যান্ডফল করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যেখানে নাগোয়া অবস্থিত। জাপান ইতিমধ্যে এর আগমনের জন্য নিজেদের আগাম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রসঙ্গত গত কয়েকদিন ধরে ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছিল টাইফুন ১৩। জাপানের আবহাওয়া সংস্থা বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার টোকাই এবং কান্টো অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করছে, যা পরিবহন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।আবহাওয়া দপ্তরের মতে শুক্রবার সকাল ৬ টা নাগাদ ২৪ঘন্টা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ইজু দ্বীপপুঞ্জে ২৫০ মিলিমিটার, টোকাই অঞ্চলে ১৫০ মিলিমিটার এবং কান্টো-কোশিন অঞ্চলে ১০০ মিলিমিটার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জাপানের আবহাওয়া সংস্থা (জেএমএ) .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top