ফিনিক্সের অপর নাম যখন “চন্দ্রযান”

চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধের যে অংশে বিক্রম ল্যান্ডার অবতরণ করেছে তার একটি ছবি। সূত্রঃ ISRO official twitter 

ড. সায়ন বসুঃ প্রাচীনকালের গল্পে শোনা যায় ফিনিক্স বলে একটি পাখি ছিল যে কিনা প্রতি ৫০০ বছর অন্তর নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে আবার ভস্ম থেকে নতুন করে জন্ম নিতো। চন্দ্রযান-২ এর বিক্রম লান্ডারের দুর্ভ্যাগজনক পরিণতির চার বছর পরে ২৩ অগাস্ট, ২০২৩ ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬:০৪-এ চন্দ্রযান-৩ এর হাত ধরে ভারত সমেত গোটা বিশ্ব যা দেখলো তাকে ফিনিক্স পাখি ছাড়া আর কার সাথেই বা তুলনা করা চলে ! 

প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর চোখে আমাদের ভারতবর্ষ উন্নয়নশীল দেশ হলেও এখনো আমাদের ওই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে এবং সেদিক থেকে আমরা “বামন”-এর পর্যায়েই পড়ি।  কিন্তু তা বলে কি স্বপ্ন দেখা নিষেধ ! সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা “বামন” হয়েও চাঁদের দিকেই হাত বাড়িয়েছি এবং সেই স্বপ্নের শুরু সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে Indian Academy of Sciences এর এক আলোচনা সভায় যেখানে ভারত থেকে সম্ভাব্য চন্দ্রাভিযানের কথা উঠে আসে। এরপর ২০০৩ সালের ১৫ই অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী চন্দ্রযান-১ প্রকল্পটির কথা ঘোষণা করেন।

তারপর কেটে গেছে কুড়িটা বছর এবং নাটকীয় ভাবে বলতে গেলে “বিশ সাল বাদ” আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম এমন একটা মাহেন্দ্রক্ষণে যখন গোটা পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশ তাকিয়ে ছিল চাঁদের দিকে শুধু ভারতের জন্যে! হ্যাঁ ২৩শে অগাস্ট, ২০২৩ আজকের দিনটা ভারতবর্ষকে মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নাটকীয় মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।  ভারতীয় সময় ঠিক সন্ধ্যে ৬:০৪ মিনিটে বিক্রম ল্যান্ডার যখন চাঁদের মাটি ছুঁলো তখন তার সাথে প্রায় ১৪০ কোটি ভারতবাসির অন্তরাত্মাও কোনও ভাবে ছুঁয়ে ফেললো চাঁদের বুড়ীর দেশ ! কিন্তু সব সাফল্যের পিছনেই যেমন কিছু ব্যর্থতা থাকে এখানেও ছিল । 

আজ থেকে চার বছর আগে ২০শে অগাস্ট, ২০১৯ চন্দ্রযান-২ চাঁদের কক্ষপথে ঢুকেছিলো এবং তার চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে নামার দিন ছিল ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯। কিন্তু কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্যে সেবার আর তা চাঁদের মাটিতে ধীরে নামতে পারেনি বরং আছড়ে পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গে ১৩০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্নও ভেঙে গেছিলো। সেই প্রথম আমরা স্বপ্নভাঙার যন্ত্রনা দেখেছিলাম ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (Indian Space Research Organization বা ISRO ) প্রধান কে. শিভম-এর চোখে । বিজ্ঞানীদের জনসমক্ষে খুব একটা কাঁদতে দেখা না গেলেও সেদিন স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রনা আমরা সবাই ভাগ করেই নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে বলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা প্রথমবারেই জিতে যাওয়ার থেকেও চিত্তাকর্ষক| চন্দ্রযান-২ এর “আংশিক ব্যর্থতার” পরে শুরু হলো চন্দ্রযান-৩ এর প্রস্তুতি। আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু হলো সবকিছু প্রযুক্তিগত ভাবে আরো উন্নত করার চেষ্টা।

এখানে বলে রাখা ভালো যে সমগ্র মহাকাশ গবেষণায় ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসটি হয়তো উল্লেখযোগ্য হয়েই থেকে যাবে। এটি খুবই বিরল যে একই মাসের প্রায় ৪ দিনের মধ্যে দুটি দেশ চাঁদের মাটিতে “পা” রাখার চেষ্টা করেছে| এমনটা শেষ কবে হয়েছে তা মনে করা সত্যিই বেশ কষ্টকর। রাশিয়ার ROSCOSMOS সংস্থার লুনা-২৫ যানটির চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে Boguslawsky ক্রেটারের (বা খাদের) কাছে অবতরণ করার কথা ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটির পরিণতি আমাদের চন্দ্রযান-২ এর মতোই হয়েছে, আছড়ে পড়েছে চাঁদের মাটিতে। এখানে ভুলে গেলে চলবে না, রাশিয়া চন্দ্র অভিযানের সাথে যুক্ত সেই ১৯৭০-এর দশক থেকে এবং তাদের  ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ইসরোর চন্দ্রাভিযান তুলনামূলকভাবে নতুন । তাই এটাকে লুনা বনাম চন্দ্রযান কিংবা ভারত বনাম রাশিয়া করে দেখা সম্পূর্ণ অর্থহীন।  

এবার ফিরে আসা যাক চন্দ্রযান-৩ এর কথায় । চন্দ্রযান-২ এর মতোই এর মধ্যে একটি ল্যান্ডার আছে যার নাম বিক্রম (নামকরন করা হয়েছে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক এবং ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা ড. বিক্রম সারাভাই এর নামে) এবং ল্যান্ডার-এর “পেটের” মধ্যে আছে একটি রোভার যার নাম প্রজ্ঞান (একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ জ্ঞান)। খুব সহজ কথায় বলতে গেলে ল্যান্ডার-এর মধ্যে থেকে রোভারটি বেরিয়ে এসে চাঁদের মাটিতে ঘুরে বেড়াবে এবং তার যা বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সেগুলো করবে। এবার আসা যাক কিছু প্রশ্নে যেগুলো আমাদের মনে আসতেই পারে : ১. কেন চাঁদ ? ২. কেন চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধ ? ৩. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি চাঁদকে নিয়ে ? 

এই সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিলেই বুঝতে সুবিধা হবে। সূর্য থেকে দূরত্ব অনুযায়ী যদি দেখা যায় তাহলে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন । তাই পৃথিবী থেকে মঙ্গল যেতে গেলেও মাঝে চাঁদ পড়ছে আবার নেপচুন যেতে গেলেও সেই চাঁদকে পেরিয়েই যেতে হবে । সেদিক থেকে দেখতে গেলে চাঁদে যদি মানবসভ্যতার প্রথম বসতি বা একটি স্টেশন তৈরী করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে দূরের গ্রহগুলিতে মহাকাশযান পাঠানো অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। এবার আসা যাক চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধ কেন সেই বিষয়ে। চাঁদের গোলার্ধে যে জল থাকতে পারে তা প্রথমে অনুমান করেন ১৯৬১ সালে ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির তিন গবেষক – Kenneth Watson, Bruce C. Murray, এবং Harrison Brown । তারপর থেকেই শুরু বিভিন্ন মিশনের মাধ্যমে চাঁদে জল খোঁজার কাজ । তা সে ১৯৭১ সালে অ্যাপোলো-১৪ হোক বা ১৯৭৮ সালে লুনা-২৪, অথবা ২০০৭ সালে চ্যাঙ-১ সব মিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চাঁদে জলের খোঁজ।  ২০০৮ সালে চন্দ্রযান-২ এর  Moon Impact Probe (MIP) চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে Shackleton Crater -এর কাছে বরফের সন্ধান করতে থাকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে NASA-র Moon Minerology Mapper বা M3 নিশ্চিত করে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি চন্দ্রপৃষ্টে। যাই হোক ২০১৮ সালে M3 থেকে পাওয়া তথ্য থেকে একদমই পরিষ্কার হয়ে যায় চাঁদের দুই গোলার্ধের কাছে জলীয় বরফের উপস্থিতি। ২০১০ সালের মার্চ মাসে চন্দ্রযান-১ এর Mini-SAR যন্ত্রটি চাঁদের উত্তর গোলার্ধে ৪০টিরও বেশি এমন খাদ বা Crater চিহ্নিত করে যেখানে প্রায় ৬০ কোটি মেট্রিক টন জলীয় বরফ থাকলেও থাকতে পারে । বিজ্ঞানীরা এমনটাও মনে করেন যে চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে এমন কিছু কিছু Crater থাকতে পারে যেখানে সূর্যালোক হয়তো কয়েক কোটি বছর পৌঁছায়নি এবং সেই জায়গাগুলোর তাপমাত্রা -২০৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা তারও কম হতে পারে, তাই সেই সমস্ত জায়গাতে জলীয় বরফ থাকার সম্ভাবনাও অতি প্রবল। জলীয় বরফ মানে তা থেকে পানীয় জল যেমন পাওয়া যাবে তেমনই জল থেকে যে হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে রকেটের জ্বালানি হিসেবে আর যে অক্সিজেন পাওয়া যাবে তা ব্যবহার করা যাবে মহাকাশচারীদের বেঁচে থাকার জন্যে।  এছাড়াও মনে করা হচ্ছে চাঁদের দুই গোলার্ধে (মূলত দক্ষিণ গোলার্ধে) হয়তো আরো অনেক মৌলিক উপাদানের হদিশ পাওয়া যাবে যা থেকে কিনা জানা যাবে চাঁদের ইতিহাস, অতীতে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কিনা এবং সাথে করে হয়ত আমাদের সৌর-জগতের সৃষ্টির নতুন কোনো অজানা তথ্য।

চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে বিক্রম ল্যান্ডার-এর “soft landing” এর সাথে সাথে সামনের বছর গুলোতে মহাকাশ গবেষণার যে দিক খুলে গেলো তা অভাবনীয়। বিশেষ করে এমন একটা সময় যখন আজ থেকে আর ৩-৪ বছর পরে NASA তাদের Artemis মিশনের মাধ্যমে আবার মহাকাশচারীদের পাঠাবে এবং তারাও অবতরণ করবে চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধেই। তাই বিক্রম ল্যান্ডার-এর সফল অবতরণ শুধু ISRO না, NASA-র কাছেও এক অতি বড় স্বস্তির। চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধের যে জায়গাটিতে বিক্রম অবতরণ করেছে সেই জায়গাটি আশা করি সামনের দিনে অনেক দেশ অবতরণের “টার্গেট” বলেই ব্যবহার করবে। চন্দ্রাভিযানের ভবিষ্যৎ যে কতটা উজ্জ্বল তা হয়তো এবার আমরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছি। সামনের দিনে চাঁদে গড়ে উঠবে Luner Base যেখানে কিনা মহাকাশচারীরা থাকবে গবেষণার কাজের জন্যে, সঙ্গে চাঁদ ছাড়িয়ে আরোও দূরের কোন গ্রহে পাড়ি দেওয়ার মাঝে চাঁদে জ্বালানি ভরার জন্যে থামবে কোনো রকেট ! আমরা ছোটবেলায় যেগুলো কল্পবিজ্ঞানের বইয়ের পাতায় পড়তাম সেগুলোই আস্তে আস্তে বাস্তব হতে যাচ্ছে আর এই সবকিছুর পিছনে চন্দ্রযান-৩ সাফল্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা ইতিমধ্যেই গোটা পৃথিবী উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।

লেখকের ছবি ২০১৯ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান-২ এর বিক্রম ল্যান্ডার-এর ট্র্যাকিং এর সময় দক্ষিণ আফ্রিকার HartRAO অব্জারভেটরিতে

*লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক এবং ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার HartRAO observatory থেকে চন্দ্রযান-২ এর বিক্রম ল্যান্ডার ট্র্যাকিং দলের সদস্য।

যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Scroll to Top