

American Physical Society এর মিটিং-এ GW230529 সম্পর্কিত সাংবাদিক সম্মেলন| ছবিটি LIGO এর X-handle থেকে সংগৃহীত।
ড. সায়ন বসুঃ আলবার্ট আইন্সটাইন এক শতক আগে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা বলে গিয়েছিলেন বর্তমানে বিজ্ঞানীরা তা হাতেকলমে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৫ সালে প্রথমবার এই তরঙ্গের সন্ধান পান Advanced Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO বা লাইগো)-এর বিজ্ঞানীরা। লাইগো লেজার রশ্মিগুলিকে লম্ব পথে বিভক্ত করে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করে, তাদের প্রতিফলিত করে আয়না থেকে দূরে অবস্থিত কিলোমিটার এবং তারপরে তাদের পুনরায় সংযুক্ত করে। কোটি কোটি কিলোমিটার দূর থেকে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, লেজার রশ্মি দ্বারা পরিভ্রমণ করা দূরত্বে সামান্য পরিবর্তন ঘটায়। এই ভাবে লাইগো, দুটি ব্ল্যাক হোলের একত্রিত হওয়ার মতো মহাজাগতিক ঘটনা সনাক্ত করে।
২০১৫ সালে GW150914-কে চিহ্নিত করা থেকে ২০২৩ সালে GW230529 এর সন্ধান, এর মাঝে আরোও অনেক মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন লাইগোর বিজ্ঞানীরা। কিন্তু GW230529 বেশ কিছু কারণের জন্যে কৌতূহলোদ্দীপক। তার মধ্যে অন্যতম হলো বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে “Mass-gap”। লাইগোর দেওয়া নামগুলির, যেমন GW150914, অর্থ হল এই রকম- GW যা কিনা Gravitational Waves (GW), 15 হল 2015, 09 হলো ইংরেজি মাস এবং 14 হলো তারিখ| অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গটি চিহ্নিত করা হয়েছিল। ঠিক তেমনই GW230529 এর অর্থ হলো এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গটি ২০২৩ সালের ২৯শে মে চিহ্নিত করা হয়| এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গটি ৬৫০ আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছে।
লাইগোর অন্তর্গত লিভিংস্টন ডিটেক্টর একটি ‘অজানা’ কমপ্যাক্ট বস্তুর সাথে একটি নিউট্রন তারার মিলন থেকে 29 মে, 2023 তারিখে GW230529 নামক মহাকর্ষীয় তরঙ্গটি পর্যবেক্ষণ করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এই অজানা বস্তুটি খুব সম্ভবত একটি অস্বাভাবিক হালকা-ওজন ব্ল্যাক হোল হতে পারে। এই ‘অজানা’ বস্তুটি সবচেয়ে ভারী নিউট্রন তারা এবং সবচেয়ে হালকা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে “নিম্ন ভরের ব্যবধানে” পড়ে। এই বাইনারিটির প্রাথমিক ‘অজানা’ বস্তুটির ভর ২.৫ থেকে ৪.৫ সৌর ভরের মধ্যে রয়েছে। এর প্রকৃতি অনিশ্চিত কারণ এটির ভর একটি নিউট্রন তারার প্রত্যাশিত ভরের চেয়ে বড় এবং ব্ল্যাক হোলের জন্য প্রত্যাশিত ভরের চেয়ে কম। গৌণ বস্তুটির ভর ১.২ এবং ২.০ সৌর ভরের মধ্যে রয়েছে এবং এটি অবশ্যই একটি নিউট্রন তারা।
নিউট্রন তারা এবং ব্ল্যাক হোল উভয়ই কম্প্যাক্ট বস্তু, বিশাল নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার আগে, এক্স-রে ব্যবহার করে নাক্ষত্রিক-ভরের ব্ল্যাক হোলের ভর পাওয়া গিয়েছিল এবং রেডিও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিউট্রন তারার ভর পাওয়া গিয়েছিল। এই পরিমাপগুলি আমাদের সূর্যের ভরের প্রায় ২ থেকে ৫ গুণের মধ্যে পড়ে। GW230529 হলো প্রথম এমন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যা একটি নিউট্রন তারা এবং একটি ‘Mass-gap’ বস্তুর মিলন থেকে এসেছে|
প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি কম্প্যাক্ট বস্তুর খোঁজ এখন অব্দি পাওয়া গেছে যেগুলি কিনা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ চিহ্নিতকরণের সাথে যুক্ত| এদের মধ্যে GW230529 ছাড়া আর একটি মাত্র তরঙ্গ যার নাম GW190814 চিহ্নিত হয়েছে যার মধ্যেও এই ‘Mass-gap’ বস্তুর উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। GW190814-এর ক্ষেত্রে ‘Mass-gap’ বস্তুটির ভর এখনও অব্দি জানা সবথেকে বেশি ভর বিশিষ্ঠ নিউট্রন তারার থেকেও বেশি। নিউট্রন তারা এবং ব্ল্যাক হোলের মাঝামাঝি থাকা বস্তুর ধারণা এক শতকের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু তার প্রমান এই প্রথম পাওয়া যাচ্ছে লাইগোর মতো উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে।
দুটি ব্ল্যাক-হোলের একত্রীকরণের একটি চিত্রণ| এটি NASA Universe এর X-handle থেকে সংগৃহীত।
আমেরিকার অ্যাডলার মানমন্দিরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল যেভিন-এর মতে, “আমরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ শুরু করার আগে, ব্ল্যাক হোল এবং নিউট্রন তারার মতো কম্প্যাক্ট বস্তুর বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ থেকে পরোক্ষভাবে অনুমান করা হয়েছিল। নিউট্রন তারা এবং ব্ল্যাক-হোল ভরের মধ্যে ব্যবধানের ধারণা, একটি ধারণা যা প্রায় ২৫ বছর ধরে ছিল, তা মূলত এই ধরনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা চালিত হয়েছিল। GW230529 একটি উত্তেজনাপূর্ণ আবিষ্কার কারণ এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আগের ধারণার তুলনায় এই ‘ভর ব্যবধান’ কম খালি হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।”
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিরতির পরে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণের চতুর্থ পর্যবেক্ষণ ১০ই এপ্রিল, ২০২৪-এ আবার শুরু হয়েছে| কিন্তু এবার LIGO Hanford, LIGO Livingston এর সাথে ইতালিতে অবস্থিত Virgo ডিটেক্টরও একসাথে কাজ করবে। জাপানে অবস্থিত কাগরা (KAGRA) ডিটেক্টর পরে এই পর্যবেক্ষণে যোগ দেবে। কোন পরিকল্পিত বিরতি ছাড়াই এই পর্যবেক্ষণ আগামী বছর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলবে। LIGO-Virgo-KAGRA গবেষকরা প্রথম পর্যবেক্ষণের প্রথমার্ধের ডেটা বিশ্লেষণ করছেন এবং বাকি ৮০টি উল্লেখযোগ্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরীক্ষা করছেন যা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
** লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand-এর পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত ।
আরও পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে বিতর্কে এ আর রহমান
উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে
উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন
Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন
উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন