১লা মে ২০২৫

লুপ্তপ্রায় লোকগান : ছাদ পেটানো গান

ছবি প্রতিকী

নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ বেশ কিছুকাল আগেও গ্রামবাংলায় ছাদ পেটানো গানের প্রচলন ছিল । চুন- সুরকির ভাগ যথাযথ রাখা না হলে ভালো ছাদ তৈরি হয় না। তবে, বর্তমানে এই ধরনের ছাদ তৈরিতে খরচ বেশি বলে এবং দক্ষ কারিগরের অভাবে পেটানো ছাদের প্রচলন নেই বললেই চলে । তার জায়গায় এখন প্রায় সর্বত্র সিমেন্ট- বালি – পাথর সহযোগে ঢালাই ছাদের প্রচলন দেখা যায় ।

পূর্বে পেটানো ছাদ তৈরির সময় পেটানোর একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্যে , ঘুম তাড়ানোর জন্যে , কাজের ছন্দ বজায় রাখার জন্যে কাজে নিযুক্ত মিস্ত্রি থেকে শ্রমিকেরা এক ধরনের গান গাইত । মিস্ত্রিদের সাহায্যকারী নারী বা পুরুষ মজুরের দল সুর করে গান গাইত এবং গানের তালে ছাদ পেটানোর  কাজ করত।

 মানভূমে নারী শ্রমিকেরা ছাদ পেটানোর সময় এক ধরনের ঝুমুর গাইত । মুর্শিদাবাদের ডোমকল অঞ্চলে রাজমিস্ত্রিদের মধ্যে ছাদ পেটানো গানের প্রচলন দেখা যায় । সেখানকার ছাদ পেটানো গানে আলকাপ- এর প্রভাব দেখা যায় ।

 প্রকৃতপক্ষে ছাদ পেটানো গানে কাজের আনন্দ বজায় থাকে । এ ধরনের শ্রমগানে আশেপাশের শ্রোতারাও আনন্দ অনুভব করে ।  এই ধরনের গানে আদি রস ও কৌতুক রসের মিশ্রণ দেখা যায়। আবার , কোনো কোনো গানে আত্মকথন , জীবন- অভিজ্ঞতা , দৈনন্দিন জীবনের সুখ- দুঃখ , মালিকপক্ষের প্রতি অসন্তোষ ইত্যাদি ব্যক্ত হতে দেখা যায় ‌। 

 কাঠের দণ্ড বা কুপা দিয়ে ছাদ পেটানো হয়। গানের ছন্দের সঙ্গে কাঠের দন্ড উঠে আর নামে । গানের সঙ্গে কাঠের শব্দ মিশে যায় ।

 ছাদ পেটানো গান :

 ১ )  মনে ছিল বড় বাসনা ,  ছাদ পিটানো   

  ফলার খাব,

 ফলার দিলো না ।

 কুপার ঘা এট্টে মেরো না ,

সস্তার বাজারে বাবু ফলার দিল না ,

ঘোষ বলে দিব দিব , ঘোষাল বলে দিব না 

 কুপার ঘা এট্টে মেরো না ।

২ ) ঘোলা জলের আদা পানায় ছিঁড়লো বধুর

 শাড়ি ,

নাচের তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি ।

 ও ছাদ যে পিটাইবে সে কুপা ধরেছে ,

 ঠান্ডা ঝোরের পানি এনে ছিটা মার হে ।

দৈ এর মত চুনের জল খাচ্ছে গড়াগড়ি 

 নাচের  তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি,

 ও বঁধূ কুপা নিয়েছে , বঁধূ চোখ মেরেছে ,

 বঁধূ হাতে কুপা দেখে ছোকরা মেতেছে ,

 হাটের মাঝে বঁধূ বুঝি ভাঙ্গবে ভাতের হাড়ি ,

 নাচের তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি।

৩ )  ছোকরা বন্ধ ছাদ পেটায়,বঁধূর মুখে হাসি 

 ছোকরা বুঝতে পেরেছে, বঁধূ মেতে গিয়েছে।

 তালে তালে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে ।

 ছোকরা বুঝতে পেরেছে  খেলা শুরু হয়েছে। 

কুপার তালে প্রেমের খেলা দেখবে এসো হে, 

দয়াল গুরুর নামেতে ছাদ হইল কষাকষি , 

হাতের কুপা ফেলে বন্ধু বাজাও মোহন বাঁশি । 

দয়াল গুরুর নামে এবার তুলো তিনের বাড়ি।

৪ ) ‘ আমি একজন রাজমিস্ত্রি  ‘ গানটিতে আত্মকথন ও মালিক শ্রেণির প্রতি শ্রমিক-মজুরদের অসন্তোষ ব্যক্ত হয়েছে – 

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি, 

টাকা নিব, ঘর করিব গো ,

ওই আমরা করিব না জুয়াচুরি ।

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি,

 ঘর করিব বলে মোরা আছি আছি হেথায় ,

 টাকা পয়সা মারিয়ে দিয়ে মালিক পালিয়ে 

গেল কোথায় ,

এখন আমরা পড়লাম ফ্যারে কি করি উপায়,

হায়, আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর

 তৈয়ারি ।

মালিক খুঁজে বের করিব , টাকা-পয়সা না

 দিলে,

 ঘর ফেলে দিব ।

 কি করিবে বোকা মালিক, রবে তুমি শুয়ে 

কোথায় ?

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

 গরিব খাটিয়ে ফাঁকি দিলে চলে যাবে গো 

এই সংসারে কালে ।

পরকালে পড়বে গো ফ্যারে – 

ভগবান তোমারে না দেবে রে , হায়

 আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

 বড় কষ্টে ঘর করিলাম , মাচায় মাচায় ছুটে

 বেড়াইলাম ,

প্রানের ভয় নাহি করিলাম ।

শেষকালে পয়সা নাহি পাই,

 আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

৫ )  ও ছাদে যে খেলিবে সে নাইতে গিয়েছে ,

 ঘোলা জলে অঙ্গের শাড়ি লেপ্টে গিয়েছে ।

 কুপার ( কাঠের দন্ড )  তালে ঘোলা জলে

 ভিজলো বঁধূর শাড়ি ,

 ছাদ পিটাও হে নয়া বঁধূ , কইরোনা আড়ি ।

ও যে ছাদ পিটাইবে  সে ইশারায় ডাকে ,

সুরকি মাখা পানি তাহার মাথায় ঢাল হে ,

 ছাদ পিটাও হে নয়া বন্ধু মার  কুপার বাড়ি ,

 কইরো না আর আড়ি ।।

 ছাদ পেটানো গানের প্রচলন আজ প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে । বর্তমানে সর্বত্র ঢালাই ছাদের ব্যবহার দেখা যায় ‌। ছাদ পেটানো গানগুলি যদি লিখিত আকারে ধরে রাখা না হয় , তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এগুলি সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত থেকে যাবে । অথচ এই গানগুলি লোকসংস্কৃতির জগতে বিশেষত লোকগানের আঙিনায় অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তথ্য সহায়তা ও ঋণ স্বীকার :

শ্রম সঙ্গীত :  শক্তিনাথ ঝা , লোকসংস্কৃতি ও

 আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র , তথ্য ও সংস্কৃতি 

বিভাগ , পশ্চিমবঙ্গ সরকার , প্রথম প্রকাশ : 

জুন  , ২০০৩  ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন