

ছবিটি X-handle থেকে সংগৃহীত |
গৌতম কুমার দাঁঃ সৃষ্টির সেই ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ যখনই প্রকৃতির রোষানলে পড়েছে তখনই আরাধনায় ব্রতী হয়েছে সেই সব অসীম শক্তির। সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে সেইসব শক্তি গুলি বৈদিক ঋষিদের দ্বারা রূপ লাভ করলো দেব শক্তিতে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিভিন্ন পুরাণে যে সকল দেবতা বা দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে তাঁরা প্রাকৃতিক শক্তিরই বিভিন্ন রূপ। ঋষিগণ বিভিন্ন বিশষণে বিশেষিত করে তাঁদের মহিমা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন।
যে শক্তি অসীম অনন্ত সেই সব শক্তি গুলিকে তাঁরা কখনো বুদ্ধি রূপে, কখনো শান্তি রূপে,কখনো শক্তি রূপে, লক্ষ্মীরূপে বিভিন্ন ভাবে উপসনার জন্য অখণ্ড অনন্ত শক্তিকে খণ্ড খণ্ড রূপ দান করলেন। ত্রিকালঞ্জ ঋষিগণ উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির যেসব শক্তির দ্বারা মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন সেইসব শক্তিকে মানুষের উচিৎ শ্রদ্ধা জানানো, তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা এবং তাঁদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা।
একদিন যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করেছিল কালক্রমে সেই ধর্মই মানুষের অজ্ঞানতা বশত হয়ে পড়লো আচার সর্বস্বতার নামান্তর মাত্র। ধর্ম তার উদ্দেশ্য হারিয়ে প্রবাহিত হলো বারিহীন শুষ্কখাতে। উদ্ভব হলো কিছু লোভী, স্বার্থানেষী মানুষের। যারা ধর্মের নামে শুরু করলো ভণ্ডামি। সাধারণ মানুষের কাছে মূল সত্য অগোচরেই থেকে গেল। মানুষ লালন করলো,পালন করলো,ধর্মকে নয় ; ধর্মের বিপরীত দিকটিকে। এই বিপরীত ধর্ম সাধনার ফলে সমাজে জন্ম নিল এক বিষাক্ত পরিবেশের। যার বিষবাষ্পে মানুষের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ছে। ফায়দা তুলছে বিভিন্ন নীতিহীন রাজনীতি বীদেরা।
বর্তমানে ধর্মকে কেন্দ্র করে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত মানুষের নতুন করে ভাববার একটা সময় এসেছে যা চিরন্তন, সত্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এবং মিথ্যারে করা দূরে পরিহার। যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মনীষীরা যেমন জরাথ্রুস্ট,কনফুসিয়াস, যীশুখ্রীস্ট, বুদ্ধদেব, কবীর,নানকেরা তাঁদের প্রেম ও শান্তির বাণী দিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, তেমনি আমাদের বঙ্গভূমি যাঁদের পাদস্পর্শে তীর্থ ভূমিতে পরিণত হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীশ্রী চৈতন্য দেব, পরম পুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দ। যুগনায়ক বীরেশ্বর বিবেকানন্দ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে ধর্মের যেসব ব্যাখ্যা করলেন তা মানুষের কাছে এক অন্য মহিমা নিয়ে হাজির হলো। ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর এই বিশ্লেষণ সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের কাছে তো বটেই বরং নতুন প্রজন্মের আধুনিক তরুণ সম্প্রদায়ের দায়ভার স্বামীজীর সেইসব গ্রন্থ গুলিকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মূল্যায়ন করা। যা জাতি এবং সমাজ তথা দেশ ও দশের সকলেরই মঙ্গল। তিনি বললেন ধর্মান্ধতা নয় ধর্মকে ধারণ করে চলাই মানুষের মূলমন্ত্র। স্বামীজী হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পদব্রজে পরিভ্রমণ করে অনুসন্ধান করে দেখলেন, ভারতীয়দের দুঃখের কারণ। তাই তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন -” খালি পেটে ধর্ম হয় না”। অর্থাৎ ধর্মকে জিইয়ে রাখতে গেলে কর্মের দরকার। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন – “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন”। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ তার বিপরীত ব্যাখ্যা করলেন। তাঁরা মালা হাতে বসে পড়লেন কৃষ্ণের গুণগান করতে। তাঁরা ভাবলেন – ” জীব দিয়েছেন যিনি আহার যোগাবেন তিনি “। আর অন্যদিকে বিদেশীরা যীশুর প্রেমের বাণী ছেড়ে গ্রসণ করলেন কৃষ্ণের কর্মের বাণী, তাই তাঁরা আজ উন্নত থেকে উন্নততর দেশে পরিণত হয়েছে। আর আমরা যথা পূর্বং তথা পরংই রয়ে গেলাম।
ধার্মিক কে- এ প্রসঙ্গে স্বামীজী বললেন – না, যে নিজের বীর্য প্রকাশ করে পৃথিবীকে ভোগ করতে পারে তিনিই ধার্মিক। অর্থাৎ বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা। মূলত বিবেকানন্দের মতে ধর্ম হচ্ছে কর্ম মূলক। অবশ্য সেই কর্ম হতে হবে সৎ -পবিত্র ও কল্যাণ মূলক। আর ধার্মিকের লক্ষণ প্রসঙ্গে বললেন সদা কর্মশীলতার কথা। এমনকি অনেক মীমাংসকের মতে বেদে যে স্থলে কার্য করতে বলছে না, সে অংশগুলি বেদই নয়– “আম্নয়স্য ক্রিয়ার্থত্বাদ অতদর্থানাং। ” তাই জড়ত্ব তমোগুণ ঝেড়ে ফেলে সমস্ত মানুষকে এই তরুণ সন্ন্যাসী – “ওঠো জাগো নিজের প্রাপ্য বুঝে নাও ” মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করলেন।
বিবেকানন্দ যেমন একদিকে কর্মের মধ্য দিয়ে মানব জাতির ধর্মের কথা বললেন অন্যদিকে তেমনি মানব প্রেমের কথাও ঘোষনা করলেন। আজ আমরা যেযুগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছি তাতে মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু বোধ হয় মানুষই। মানুষ তার শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে আত্ম চরিতার্থের জন্য যেন তেন প্রকারেণ ছলে বলে কৌশলে অন্য মানুষের ক্ষতি করে একে অপরকে ফাঁকি দিয়ে ইঁদুর দৌড়ে জয়ী হতে চায়। একদিন মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে বাঁচার জন্য যে ধর্মকে আশ্রয় করে সমাজ তৈরি করলো ; সেই সমাজেই যদি মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তাহলে সাধারণ মানুষ যায় কোথায়? বারেবারে বিভিন্ন মহাপুরুষেরা এসে আমাদের মানুষকে ভালোবাসার কথা, ক্ষমা করার কথা শুনিয়েছিলেন আজ যেন সেই সকল বাণী গুলিকে আমরা ব্যর্থ নমস্কারে দূরে বহুদূরে সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বর্তমান এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে স্বামীজীর সেই অমোঘ বাণীর দিকে-
” বহু রূপে সম্মুখে তোমার,
ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। “
রামকৃষ্ণদেব নররূপে নারায়ণ সেবার যে দীক্ষা স্বামীজীকে দিয়েছিলেন তারই প্রতিফলন আমরা এই বাণীর পরতে পরতে দেখতে পাই। কিন্তু আমরা মানুষকে ভালোবাসার পরিবর্তে, মানুষের ঠাকুরকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে রেখে মুখোশ দিয়ে মুখকে আড়াল করার জন্য বহু ব্যয় সাধন করে ও বহু উপাচার সহযোগে বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করে চলেছি এবং পশ্চাতাপ করছি যে, এতো করে ডেকেও ভগবান আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে স্বামীজীর বাণী প্রনিধানযোগ্য:-
” দেশশুদ্ধ পড়ে কতই ‘হরি’ বলছি, ভগবানকে ডাকছি, ভগবান শুনছেনই না আজ হাজার বৎসর। শুনবেনই বা কেন? আহাম্মকের কথা মানুষই শোনে না —— তা ভগবান।”
শেষে একটা কথা বলতেই হয়, বিঞ্জানের বিশেষ জ্ঞানের উপর ভর করে আজ আমরা হয়তো একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক হিসাবে গর্ববোধ করি। কিন্তু বিজ্ঞানের কিছু যন্ত্রের চাপাকলে মানবতাবোধকে পিষ্ট করে নিজেদেরকে যন্ত্র মানবে পরিণত করাই মানবিকতার লড়াই নয়। সময় হয়েছে জাতি – ধর্ম – বর্ণ – সম্প্রদায় ভুলে ; সাদা – কালো – হলুদ সমস্ত বর্ণের মানুষকে বিশ্বের মহামিলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে হবে —
” সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। “
তাহলেই হয়তো বা সেইসব মহাপুরুষদের আমরা যথার্থ সম্মান বা শ্রদ্ধা জানাতে পারবো এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারবো মানবতাবোধকে।
আরও পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার
উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে। যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়। এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে। এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন