জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে সহনশীল ফল ও সবজি উৎপাদন কি সম্ভব?

উত্তরাপথঃ জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর কৃষিক্ষেত্রের সামনে এক বড় সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, অতিবৃষ্টি এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস—এই সমস্ত প্রভাব আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফল ও সবজি, যেগুলো আমাদের খাদ্যচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেগুলোর উৎপাদন এই পরিবর্তনের কারণে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা খোঁজ করছেন এমন প্রযুক্তির, যা এই ফল ও সবজিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সহনশীল করে তুলতে পারে। কীভাবে এটা সম্ভব? চলুন বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা যাক।

জলবায়ু অসামঞ্জস্যতা:
বর্ষাকাল আগেভাগে বা দেরিতে আসা, খরার সময়সীমা দীর্ঘ হওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এই সবই চাষের সময় নির্ধারণ ও সেচের ওপর প্রভাব ফেলে।

নতুন পোকামাকড় ও রোগ:
উষ্ণ পরিবেশে নতুন নতুন রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গ বিস্তার লাভ করে যা ফল ও সবজির ক্ষতি করে।

তাপমাত্রাবৃদ্ধি:

উচ্চ তাপমাত্রা গাছের ফুল ফোটার সময়ে বিঘ্ন ঘটায়, ফলে ফলন হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, টমেটো এবং স্ট্রবেরির মতো ফসল তাপমাত্রা সংবেদনশীল।

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সাহায্যে প্রতিরোধ

১. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)

বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ফল ও সবজির জিনে পরিবর্তন ঘটিয়ে সেগুলোকে জলবায়ুর প্রতিকূলতার প্রতি সহনশীল করে তুলছেন। এই প্রক্রিয়ায় এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয় যা গাছকে:

  • উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে সহায়তা করে,
  • লবণাক্ততা ও খরার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখে,
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

উদাহরণ:

  • GM টমেটো: তাপ ও খরার প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে।
  • বায়োটেক ব্রোকলি: উচ্চ তাপমাত্রা ও শুষ্ক মাটিতে ভাল ফলন দেয়।

২. CRISPR প্রযুক্তি

নতুন প্রজন্মের জিন সম্পাদন প্রযুক্তি ‘CRISPR’ এখন উদ্ভিদ উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট জিন পরিবর্তন করা যায়, যাতে ফল বা সবজি জলবায়ুর প্রতিক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

৩. প্রথাগত সংকরায়ণ (Traditional Breeding) বায়োটেক সংকরায়ণ

দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা এমন জাত তৈরি করছেন যেগুলো অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা, খরা বা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। এই জাতগুলোতে বেশি ফলন, কম পানির প্রয়োজন এবং রোগ প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য থাকে।

৪. উন্নত কৃষি প্রযুক্তি সেন্সর ব্যবহার

  • স্মার্ট সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও পুষ্টির পরিমাণ পরিমাপ করা যায়।
  • ড্রোন ও AI প্রযুক্তি চাষের উপযোগিতা বাড়ায় এবং রোগ বা ক্ষতির পূর্বাভাস দেয়।

বাস্তব উদাহরণ

  • ভারত: পাঞ্জাবে “হিট-রেজিস্ট্যান্ট” গমের জাত এবং মহারাষ্ট্রে “ড্রাউট-টলারেন্ট” টমেটো পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।
  • চীন: CRISPR প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরা সহ্য করতে সক্ষম ধান উৎপাদন শুরু হয়েছে।
  • আফ্রিকা: ‘বায়োটেক পেঁপে’ ভাইরাস প্রতিরোধী জাত হিসেবে সফল হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক

বৈজ্ঞানিকভাবে এই প্রযুক্তিগুলি সম্ভাবনাময় হলেও, এগুলি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে:

    জৈব বৈচিত্র্য হ্রাস
     একঘেয়ে জাত ব্যবহারে স্থানীয় ও প্রাকৃতিক জাত বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

   নিয়ন্ত্রক প্রতিবন্ধকতা ও জনসচেতনতা
   জিএম ফসল সম্পর্কে এখনো অনেক দেশে আইন কঠোর এবং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি  ও আশঙ্কা রয়েছে।

    ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রবেশাধিকার
     অনেক উন্নত প্রযুক্তি এখনও ছোট কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না।

জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করতে ফল ও সবজিকে আরও টেকসই এবং সহনশীল করে তোলা এখন সময়ের দাবি। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, CRISPR, বায়োটেক সংকরায়ণ ও স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে এক নতুন বিপ্লব শুরু করেছেন। যদিও কিছু সমস্যা রয়েছে, তবু এই প্রযুক্তিগুলি সঠিকভাবে পরিচালনা করা গেলে কৃষিক্ষেত্রে এক নবজাগরণ ঘটতে পারে।এক্ষেত্রে সঠিক নীতিমালা, জনসচেতনতা এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top