ভোরের শুকতারা

অনসূয়া পাঠকঃ বাস ছাড়তে তখনো কিছুটা সময় বাকি ছিলো, আমি মা বাবার সাথে বাসের ভেতরে জানালার দিকের সিটটায় বসে আছি। এমন সময় দেখি আমাদের পাশের সিটে বসে একজন রবীন্দ্রনাথের সঞ্জয়িতা পড়ছেন, বইটাকে দেখে আমার চোখের সামনে একটা সোনালী ফ্রেমের চশমা পরা মুখ ভেসে উঠলো, চন্দন স্যারের মুখ। বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার বাবা তখন জঙ্গলমহল মেদিনীপুরের আমলাশুলির পোষ্টমাষ্টার। দু কিমি দূরেই আমার পিসীমার বাড়ি। ওখানেই আমার হাইস্কুলে পড়াশোনা শুরু। আর যে স্যার আমার মননে সদা জাগরুক, বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ বলা যায় যাকে, আমার গল্প যাঁকে নিয়ে সেই চন্দন স্যারকে ওখানেই পাওয়া।
ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় ক়াঁচা পাকা চুল, সরু গোঁফ চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, এক কথায় সুদর্শন সত্যবাদী সরল সেই মানুষটিকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে আসতো। সবসময় স্যারের হাতে থাকতো পুরানো দিনের একটা হাতঘড়ি, নিয়মানুবর্তিতা শব্দটা যেনো উনার চারপাশে লক্ষ্মনরেখার মতো আটকে। স্যার শীত ছাড়া বাকি সব সময় সাদা হাফ শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে স্কুলে আসতেন। স্যারকে দেখে আমাদের মনে হতো বাংলা ভাষাতে এমন কোন গল্প কবিতা নেই যা তিনি জানেন না। সবকিছুই তিনি এতো সুন্দর সাবলীল বর্নময় করে তুলতেন তাঁর পড়ানোর সময় যে আমরা অভিভূত হয়ে যেতাম। অন্য স্যারদের ক্লাশে ঘড়ির কাঁটা যেনো আটকে থাকতো, অথচ বাংলা ক্লাশ কি ভীষণ দ্রুত শেষ হমে যেতো। ভাবতাম কেনো যে সব ক্লাশগুলোই চন্দন স্যারের হয়না ? স্যার নিজের বাড়িতে অবৈতনিক একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। যেখানে সবার প্রবেশ ছিল অবাধ। সেখানে যে সমস্ত দুঃস্থ ছাত্র ছাত্রীরা পড়তে যেতো, স্যার তাদেরকে নিজের বেতনের টাকা খরচ করে একবেলা খাওয়াতেন ও বই খাতা কলম কিনে দিতেন। স্যারের ছোট্ট সংসারে তাঁর স্ত্রী এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। এবং বেতনের বেশীরভাগই খরচ করতেন হত দরিদ্রদের পেছনে।

প্রতি রবিবার আমিও স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। এমনিতেই বাংলা ছিলো আমার পছন্দের সাবজেক্ট। স্যার আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও আরও নানাধরনের গল্প কবিতা তিনি আলোচনা করতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, তিনি যেনো স্যারের আদর্শ। সঞ্চয়িতার অনেক কবিতাই তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। স্যার বলতেন পড়াশোনা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের জন্য। মাঝে মাঝে স্যারের স্ত্রী আমাদের জন্য দারুণ দারুণ সব খাবার বানিয়ে দিতেন। স্যারের স্ত্রীর কথাই ছিলো এরাও আমাদের ছেলে মেয়ে। আমিও মাঝে মাঝে স্যারের জন্য মায়ের হাতের বানানো পিঠে ও ছানা শীতল নিয়ে যেতাম। স্যার সবাইকে দিয়ে বেশ তৃপ্তি করে খেতেন। এরকমই বেশ কাটছিল সময়। তারপর একদিন শুনলাম স্যারের মেয়ে সন্ধ্যা দিদির জন্য স্যার একটি পাত্র খুঁজেছেন। ছেলেটি নাকি দেখতে খুব সুন্দর, পাশের থানার সাব ইনসপেক্টার। আমরা শুনে সবাই মহাখুশী। সন্ধ্যা দিদির বিয়েতে বেশ হৈচৈ হবে। কিন্তু সমস্যা হলো যে পাত্র পক্ষ বরপন হিসেবে নগদ দশ লক্ষ টাকা ও একটি ফোর হুইলার চেয়ে বসলো। কিন্তু স্যারের এতো টাকা দেবার মতো সামর্থ্য ছিলো না। স্যার পাত্রপক্ষের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করেও নিস্ফল হয়েছিলেন। এরপর সন্ধ্যাদিদির দেখতে ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি সম্বন্ধই আর্থিক কারনের জন্য ভাঙতে শুরু করে। তবে এই সাংসারিক সমস্যা স্যারের চলার পথে বাধা তৈরী করতে পারেনি। স্যারের হাসিমুখ কখনও ম্লান হয়নি। স্যার বলতেন ,জীবনে হতাশার কোন স্থান নেই, জানবে সব থেকে গভীর কালো অন্ধকার রাতের পরেই সোনালি সকাল আসে।

এর কিছুদিন পর বাবার বদলি হয় বাঁকুড়া সদরে। খুব কষ্ট হয়েছিলো সেই স্কুল লালমাটির গ্রাম আর চন্দন স্যারকে ছেড়ে আসতে। বাবার বদলি হয়েছে শুনে স্যার বলেছিলেন, “দুঃখ করিসনা জানবি আমার আশীর্বাদ সবসময় তোকে আলোর পথ দেখাবে।” যেদিন আমরা সব মালপত্র গুটিয়ে চলে আসছিলাম, বাবা বলেছিলেন চল স্যারের সাথে দেখা করে আসি। কিন্তু আমি পারিনি। চোখের জল লুকিয়ে পারিনি স্যারকে বিদায় প্রনাম করে আসতে।
আজ পাঁচ বছর পর আবার সেই গ্রামে যাচ্ছি। পিসীমার মেয়ে মালতী দিদির বিয়েতে। ভালো পাত্র। সদ্য ঢুকেছে মহকুমা হাসপাতালে। পিসাবাবু বরপন হিসেবে মেদিনীপুর টাউনে দশ কাঠা জমি হীরের আংটি ও বাড়ির সমস্ত আসবাব দিচ্ছেন।
এইসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় নিয়ে পৌঁছে গেলাম আমলাশুলি বাস স্ট্যান্ডে। নেমেই দেখলাম পাঁচ বছরে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি এলাকার।
পিসাবাবু স্ট্যান্ডেই ছিলেন। ওখানে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে মালতী দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম চন্দন স্যারের কথা। মালতী দিদি বললো, স্যার এখন মানসিক ভাবে অসুস্থ, কারো সাথে খুব একটা কথাও বলেননা, মাঝে মাঝে চিনতেও ভুল করেন। বেশীর ভাগ সময় একাই বই হাতে বসে থাকেন।
একটার পর একটা সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়া, পাড়া পড়শীর নানান ধরনের কথাবার্তা, বাবার চাপা যন্ত্রণা, মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে সন্ধ্যা দিদি কাওকে কিছু না বলে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছালো, তাতে লেখা ছিল, ” বাবা, আমি ভোরের খোঁজে যাচ্ছি।”
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর সন্ধ্যা দিদিকে পাওয়া যায়নি। চন্দন স্যারের স্ত্রী এই দুঃখ সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে পা বাড়ান।

সব শুনে আমার মন ভীষণ বিষন্ন হয়ে ওঠে। গোটা ঘরে কেমন যেনো অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতা। নিজের অজান্তেই চোখ জলে ভরে যায় আমার। এই নীরবতা ভেঙে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা স্যারের দেখাশোনা এখন কে করেন ? পিসাবাবু উত্তর দিলেন, উনার ছেলে আদিত্য স্থানীয় ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে , ওই বাবাকে দেখে। আর থাকতে পারলাম না, ছুটে বেরিয়ে গেলাম স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌছে দেখলাম তার বাড়ির গেটে এখনো সাদা মার্বেল পাথরের উপরে লাল কালির সেই লেখাটা, ” খুলে দাও দ্বার নীলাকাশ করো অবারিত”। তবে লেখাটির উপর প্রবহমান সময়ের অস্থিরতার সুস্পষ্ট ছাপ বোঝা যায় । বারান্দায় ইজি চেয়ারে উস্কোখুস্কো চুলে একমুখ দাড়ি নিয়ে স্যার বসে, হাতে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। চুপি চুপি গিয়ে প্রনাম করলাম স্যারকে। চোখের জল তখন আর গোপন নেই। আমার মাথায় হাত দিয়ে আমার হাতে সঞ্চয়িতা ধরিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, “তোর জন্যই রেখেছিলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা চোখে তিনি বললেন, জানিস রবীন্দ্রনাথকে জানলে গোটা বিশ্বকে জানা যায়।”

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top