ধানের সাধ ভক্ষণ : জিহুড়

ড.  নিমাইকৃষ্ণ মাহাত: আশ্বিন সংক্রান্তিতে কৃষক সমাজের মধ্যে জিহুড় পার্বণ পালিত হয়। কৃষক সাধারণের মধ্যে জিহুড় পার্বণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জিহুড় অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তির সময় বহাল জমিতে লাগানো ধান বা বড়ান ধানে থোড় আসতে শুরু করে। সুতরাং ধান গাছ গর্ভাবস্থায় থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় নানা ধরনের আচার-সংস্কার পালন করা হয়। এই সংস্কারগুলির অন্যতম হলো ” ‘ মাসি ” অর্থাৎ গর্ভাবস্থার নবম মাসে যে আচার -অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এর কিছুদিন পরেই সন্তানজন্মগ্রহণ করে। মানব- সমাজের গর্ভাবস্থাজনিত এই ধরনের আচার সংস্কারের সঙ্গে ধান গাছের গর্ভাবস্থার কারণে পালনীয় অনুষ্ঠান জিহুড়ের সাদৃশ্য থাকে দেখা যায়। সেই জন্য অনেকে জিহুড় অনুষ্ঠানকে ধান গাছের ‘সাধভক্ষণ’  বলে থাকেন। জিহুড়-এ ধান গাছ অর্থাৎ মা লক্ষ্মীকে বিশেষ রীতি -আচারের মধ্যে দিয়ে  আপ্যায়িত করা হয়। জিহুড়– এ ভোগের বিভিন্ন রকম উপকরণ সহকারে ধানের গাছ তথা মা লক্ষ্মীকে সাধভক্ষণ করানো হয়। এই ভোগ দেওয়ার দু’রকম পদ্ধতি রয়েছে – (ক) কাঁচা পদ্ধতি ও  (খ) পাকা পদ্ধতি

(ক) কাঁচা পদ্ধতি : মান গাছের একটি বড় পাতায় কলা , ওল , আলতি (কচু), আদা, চুরকু আলু বা খাম আলু ,কুমড়া, বরবটি, আখ, পুই -এই নয় রকম উপকরণ কাঁচা অবস্থায় অর্থাৎ রান্না না করে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। এই উপকরণগুলির সাথে দুধ, দই, ঘি ,গুড়  দিয়ে মাখানো আতপ চালও থাকে।

(খ) পাকা পদ্ধতি : অনেকে আবার কলা, ওল, আলতি(কচু), আদা, চুরকু আলু ( খাম আলু), কুমড়া, বরবটি, আখ,পুই ইত্যাদি দিয়ে নয় রকমের তরকারি প্রস্তুত করে এবং ধানের ক্ষেতে জিহুড় ডাক দিয়ে অর্থাৎ মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে কিছু বলে এগুলি মা লক্ষ্মীকে ভোগ হিসেবে দেয়। এখানে মা লক্ষীকে সন্তান সম্ভবা  হিসেবে কল্পনা করা হয়। জিহুড় – এ মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে ভোগ দেওয়ার এই পদ্ধতিটিকে পাকা পদ্ধতি বলা হয়। বিভিন্নভাবে জিহুড় ডাক দেওয়া হয়।  যেমন – 

 ১ ) ওলের চাকা, মানের পাতা,

           ভজ লক্ষ্মী, দুধ, গুড়, চাল।

      ২ ) ইন্দুর বিন্দুররে,

           চোর চন্ডালের  মুখ বাঁধিরে।

      ৩ ) লোকের ক্ষেতে আলমাল;

            আমার  ক্ষেতে শুধুই চাল।  

      ৪ ) ইন্দুর, বিন্দুর, গাঁধী 

            তিনের মুখ বান্ধি।

 ( শব্দার্থ : চাকা:  গোলাকৃতি চাকার মত ; মানের: মান গাছের ; ভজ :  ভক্ষণ করা; আলমাল : যেমন তেমন, নিকৃষ্ট ;  গাঁধী: গাঁধীপোকা । )

জিহুড় – এর দিনে অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তিতে ক্ষেতে জিহুড় ডাক দিয়ে কৃষকেরা সাধারণত উপরের শ্লোকগুলি বলে থাকেন। মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে ডাক দিয়ে তারা নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করে। ক্ষেত  থেকে এক ধরনের বিশেষ ঘাস (জুয়ান) মাথায় করে নিয়ে আসা হয় এবং পিছু পিছু একজন ভোগের (প্রসাদের) পাত্রটি মাথায় করে নিয়ে আসে। উভয়ে বাইরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ঘরের লোক তা বুঝতে পারে এবং ঘরের একজন মহিলা ঘটি থেকে জল-ধারানি দিয়ে অর্থাৎ জল ফেলতে ফেলতে বাইরের দরজা থেকে কৃষককে ঘরের ভিতরে দেব-দেবীর মূর্তির সামনে নিয়ে আসে। ওই স্থানে পূর্ব থেকে রেখে দেওয়া চালের গুড়ি (পিটুলি) মাখানো পিঁড়ির উপরে কৃষকের মাথায় থাকা বিশেষ ধরনের ঘাসের (জুয়ান ঘাসের) আঁটিটি রাখা হয় ; সামনে থাকে ভোগের থালাটি। কৃষক মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে। এরপর , ঘরের লোক (সাধারণত গৃহিণী)  চাষিকে জিজ্ঞাসা করে যে,  মা লক্ষ্মী কি বলল ? উত্তরে চাষি  বলে যে, মা লক্ষ্মী খামার তৈরি করতে বলল । ঘরের লোক আবার জিজ্ঞাসা করে, মা লক্ষ্মী আর কি বলল ?  উত্তরে চাষি বলে যে, বড় ও শিকল পাকাতে বলল। কৃষক-গৃহিণী পুনরায় জিজ্ঞাসা করে যে, মা লক্ষ্মী আর কি বলল ? উত্তরে কৃষক জানায় যে ‘পাড়ন খুঁটা‘ তৈরি করতে বলল। পাকা ফসল কেটে এনে প্রথমে খামারে রাখা হয়। তাই, ক্ষেতে ফসল পাকার সাথে সাথেই বাড়িতে পাকা ফসল ঝাড়াই পর্যন্ত রাখার জন্য খামারের প্রয়োজন হয়। ধানের আঁটি থেকে ধান ঝাড়াইয়ের পর সেই ধান মজুত রাখার জন্য মরাই, কুচুড়ি (পুড়া) ইত্যাদি তৈরিতে খড়ের বড় (অর্থাৎ বেড়ি) এবং শিকল (অর্থাৎ খড়ের দড়ি) ব্যবহৃত হয়। কুচুড়ি বা পুড়ার নিচের অংশ যাতে মেঝের সংস্পর্শে স্যাতস্যাতে হয়ে না যায় বা উইপোকা আক্রমণ না করে সেই জন্য পুড়াকে  দুটি কাঠের পাঠাতনের উপর (পাড়ন-খুঁটা) উপর রাখা হয় তাই জিহুড় ডাক- এর সময় মা লক্ষ্মী যেন উৎপন্ন ফসল ঘরে তোলার আগে এই তিনটি প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দেন। এছাড়া, জিহুড়ে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

পুরুলিয়া জেলার বোরো থানার অন্তর্গত বসন্তপুর , তামাখুন অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেতে জিহুড় ডাক দেওয়া হয়। জিহুড় ডাক দেওয়া ক্ষেতের ধানকে এই অঞ্চলে ধুলা ধান বলে। এই অঞ্চলে প্রচলিত লোকবিশ্বাস হল যে, জিহুড় ডাক দেওয়া ওই বিশেষ ক্ষেতে উৎপাদিত ধান শুধুমাত্র পূজা-অর্চনা, রীতি-সংস্কার ইত্যাদি ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। সেই ধান অন্য কাউকে দেওয়া হয় না। সেই ধান থেকে দৈনন্দিন খাবার হিসেবে ভাতের চাল তৈরি করা হয় না। ওই ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করা হয় যা সারা বছরের পূজা-অর্চনা, রীতি-সংস্কার পালনের কাজে লাগানো হয়। এই সমস্ত পূজা-অর্চনা, রীতি-সংস্কারের মধ্যে রয়েছে গুড়ি দিয়ে আলপনা আঁকা, বাঁধনা পরবে তিলের ফুল বা পাতা ভিজিয়ে অথবা অর্জুন পাতা, ঢেঁড়স পাতা বা ছাল ভিজিয়ে তৈরি আঠা জাতীয় জলে ওই আতপ চালের গুঁড়ো মিশিয়ে চক্ পুরা ( বিশেষ ধরনের নক্সা) হয় , বাঁধনা পরব, মকর সংক্রান্তি ইত্যাদি পরবে ওই আতপ চাল থেকে পিঠে তৈরি করা হয়। এইভাবে জিহুড় ডাক দেওয়া ক্ষেতের ধান বা সেই ধান থেকে তৈরি আতপ চাল পরবর্তী বছরের মকর পরব অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত বিভিন্ন পালপার্বণে কাজে লাগানো হয়।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


শালডিহা কলেজের ছাত্রীদের জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্স

উত্তরাপথঃ বাঁকুড়া জেলার শালডিহা কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ সমীর কুমার মণ্ডল এর উদ্যোগে এবং Mahindra Group - এর Mahindra Pride Classroom ও Naandi Foundation -এর যৌথ উদ্দগ্যে শুধু মাত্র ছাত্রীদের জন্য ৭ দিনের (৪০ ঘন্টা) একটি সার্টিফিকেট course -এর আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন রকম স্কিল নিয়ে বিশদে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে হল communication skill, soft skill, life skill, presentaion skill ও interview skill ইত্যাদি। Mohindra Educator -এর ভূমিকাই আসেন সরোজ রাই। তিনি মনে করেন, এই জাতীয় প্রশিক্ষণ শালডিহার মতো প্রান্তিক কলেজের মেয়েরা খুবই উপকৃত হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আশা করে ভবিষ্যতে মাহিন্দ্রা গ্রুপ এই কলেজে ক্যাম্পাসিং এর .....বিস্তারিত পড়ুন

টিউমার নির্মূল এর নতুন থেরাপিউটিক যা স্থায়ীভাবে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার দূর করে

উত্তরাপথ: একটি বহু-প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা দল একটি অভিনব ক্যান্সার থেরাপিউটিক তৈরি করেছে, অ্যান্টিবডি টুকরোগুলিকে আণবিকভাবে তৈরি করা ন্যানো পার্টিকেলগুলির সাথে একত্রিত করে, যা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরের ক্যান্সারকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করে। "হিট অ্যান্ড রান" ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম, কর্নেল প্রাইম ডটস (সি' ডটস) নামে পরিচিত, এটি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য একটি বহুমুখী এবং অভিযোজনযোগ্য চিকিত্সা হিসাবে সম্ভাব্যতা দেখায়, ন্যূনতম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং বিষাক্ততার সাথে। গবেষকদের একটি বহু-প্রাতিষ্ঠানিক দল আবিষ্কার করেছে যে একটি নতুন ক্যান্সার থেরাপিউটি .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top