গুরুশিখর, মাউন্ট আবু: একটি আধ্যাত্মিক এবং দর্শনীয় বিস্ময়

গুরুশিখর, মাউন্ট আবু ছবি – উত্তরাপথ

উত্তরাপথঃ আজ আমরা চলে এসেছি রাজস্থানের আরাবল্লী রেঞ্জে অবস্থিত, পাহাড়ী শহর মাউন্ট আবুতে।আর পাঁচটা পাহাড়ী শহরের মত এই শহরটি তার অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনোরম জলবায়ু এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য পরিচিত। মরুভূমি রাজ্যের এই পাহাড়ী শহরের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হল গুরুশিখর,এটি আরাবল্লী রেঞ্জের সর্বোচ্চ বিন্দুতে অবস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান। গুরুশিখর, প্রায়শই গুরু শিখর নামে পরিচিত, আজও বহু ভ্রমণকারী আধ্যাত্মিকতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অ্যাডভেঞ্চারের এক অপূর্ব স্বাদ পেতে এই  স্থানে আসেন।

গুরুশিখর তার আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্য বিখ্যাত। “গুরুশিখর” নামটি হিন্দিতে বলা হলেও বাংলায় এটিকে ‘গুরুর শিখর’বলা হয়। এটি হিন্দুধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবতার ভগবান দত্তাত্রেয়কে সমর্পণ করা  হয়েছে। ভগবান দত্তাত্রেয়কে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করা হয় যিনি ঋষি দম্পতি অত্রি এবং অনসূয়ার পুত্র । ‘দত্ত’ শব্দের অর্থ প্রদত্ত এবং যেহেতু তিনি অত্রির পুত্র ছিলেন তাই তার নাম রাখা হয়েছে ‘আত্রেয়’ এইভাবে তার নাম হয় দত্তাত্রেয় । বিশ্বাস করা হয় যে দত্তাত্রেয় ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এই স্থানটিকে পবিত্র করার জন্য এই চূড়ায় তিনি তার পা রেখেছিলেন।আজও এই পর্বত শিখর পরিদর্শন করার সময়, পাথুরে গুহাগুলিতে প্রভুর পদচিহ্নের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই পবিত্র স্থানে আসেন। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি সহ কাঠের ফ্রেমে ঝুলানো একটি বিশাল ঘণ্টা দেখা যায়।

এই জায়গার উপরে রঘুনাথজি মন্দিরও দেখার মতো। এই মন্দিরে স্বামী রামানাথের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়, যিনি তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত ঋষি ছিলেন। ভগবান দত্তাত্রেয়ের মাতা অনসূয়ার মন্দিরটিও ভক্তদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ।এছড়াও  ইতিহাস অনুসারে, রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে এবং তার সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন করতে এই শিখর বরাবর ভ্রমণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। পৃথ্বীরাজ চৌহানের স্ত্রী ছিলেন প্রহ্লাদনপুরের রাজকন্যা, যা এখন পালনপুর নামে পরিচিত। মাউন্ট আবু ভ্রমনের অংশ হিসাবে এই চূড়ায় ট্রেকিং করা অন্যতম আকর্ষণ ।

সূর্যাস্তের ছবি, মাউন্ট আবু । ছবি – উত্তরাপথ

গুরুশিখর শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্র নয় এটি মনোমুগ্ধকর মনোরম দৃশ্যর জন্যও বিখ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৭২২ মিটার (৫,৬৫০ ফুট) উচ্চতায়, এটি আরাবল্লী রেঞ্জের সর্বোচ্চ বিন্দু। এখান থেকে দর্শনার্থীরা আশেপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। দুর্গম পাহাড়ের শিখর থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখা সত্যিই একটি জাদুকরী অভিজ্ঞতা, যেখানে সূর্যের রশ্মি সমগ্র অঞ্চলকে উষ্ণ, সোনালি রঙে আলোকিত করে।

অ্যাডভেঞ্চার উৎসাহীদের জন্য, গুরুশিখর দীর্ঘ  পদযাত্রার এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা দেয়। শিখরে যাওয়ার পথটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু আনন্দদায়ক। পর্বতারোহণটি মাউন্ট আবু্র পাহারের নিচ থেকে শুরু হয় এবং সু-চিহ্নিত পথটি আপনাকে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ঘন বনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। পথের ধারে, আপনি এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের সাক্ষী হতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং বন্যপ্রাণী। গুরুশিখর যাত্রা শুধু একটি শারীরিক অ্যাডভেঞ্চার নয়; এটি প্রকৃতির বিস্ময়ের সাথেও একটি পরিচিত হওয়ার সুযোগ।

গুরুশিখর, মাউন্ট আবু ছবি – উত্তরাপথ

গুরুশিখার দেখার সর্বোত্তম সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ যখন আবহাওয়া মনোরম হয় এবং মাউন্ট আবুর নৈসর্গিক সৌন্দর্য তার শীর্ষে থাকে। বর্ষা ঋতুতে, অঞ্চলটি সবুজ হয়ে ওঠে, যা দেখার জন্য এটিকে একটি সুন্দর সময় করে তোলে, তবে পিচ্ছিল পথের কারণে পদযাত্রা করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

মাউন্ট আবু শহর থেকে গুরুশিখর সহজেই যাওয়া যায় এর নিকটতম প্রধান শহর হল উদয়পুর, সেখানে সুসংহত সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে যা শহরটিকে রাজস্থানের বাকি অংশ এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সাথে সংযুক্ত করে। এছাড়াও আপনি স্থানীয় পরিবহন ভাড়া নিতে পারেন বা মাউন্ট আবু থেকে গুরুশিখার পৌঁছানোর জন্য ট্যাক্সি নিতে পারেন। সুতরাং, আপনি যদি রাজস্থানের মুগ্ধকর রাজ্যটি ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করেন তবে আপনার ভ্রমণপথে গুরুশিখর অন্তর্ভুক্ত করতে ভুলবেন না।

খবরটি শেয়ার করুণ

1 thought on “গুরুশিখর, মাউন্ট আবু: একটি আধ্যাত্মিক এবং দর্শনীয় বিস্ময়”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top