মানভূমে বসন্ত : অন্যরূপে

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ মানভূমে বসন্ত এক অন্য মাত্রা নিয়ে আসে। এই সময় প্রকৃতি নবসাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। গাছে গাছে কচি পাতা, কুঁড়ি, ফুল, নতুন শাখা- প্রশাখার সমারোহ। মানভূমের মানুষ অভাব ও দারিদ্র্যের দ্বারা পীড়িত হলেও তাদের মন সবসময় উদার ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম থাকে। আধুনিক সভ্যতার সর্বগ্রাসী প্রভাবে চারদিকে যখন প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান তখন মানভূমের প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষেরা বিভিন্ন পরব-পার্বণ উদযাপনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সদা তৎপর। তাই তারা বসন্তে নবসাজে সজ্জিত প্রকৃতি যাতে বিনষ্ট বা সামান্য পরিমাণও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য এই সময় কয়েকটি পরব-পার্বণের উদযাপনের মাধ্যমে নিজেদের প্রকৃতির সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। 

টাঙ্গি টাঙ্গা পার্বণ :

ফাল্গুন- চৈত্র- বৈশাখ মাসে যেহেতু মানভূম অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ অর্থাৎ শাল, পিয়াল, মহুল,  অর্জুন, হরীতকী,  আমলকি, বহেড়া ইত্যাদি গাছে নতুন পাতা,  কুঁড়ি, শাখা-প্রশাখা গজায়, শীতে পাতা ঝরানোর পর উদ্ভিদ জগত নব সাজে সজ্জিত হয়, তাই জল- জঙ্গল- জমিন কেন্দ্রিক মূলনিবাসী ও আদিবাসী কৃষকেরা এই সময় কোন গাছ তথা উদ্ভিদ কাটেনা। তারা গাছ কাটার  হাতিয়ারের প্রতীক রূপে ‘ টাঙ্গি ‘ ঘরের মাচায় তুলে রাখে এই সময়।  এই প্রক্রিয়াটিকে মানভূমে ‘ টাঙ্গি টাঙ্গা ‘ পার্বণ রূপে অভিহিত করা হয়। এই টাঙ্গি টাঙ্গা পার্বণের প্রচলন থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসী কৃষকেরা কতখানি পরিবেশ সচেতন ও পরিবেশবান্ধব।

বারুণী পরব : 

ফাগুন  ( ফাল্গুন ),  চৈত ( চৈত্র ), বৈশাখ, জষ্টি ( জ্যৈষ্ঠ ) – এই চার মাস জুড়ে বারুণী উৎসব পালন করা হয়। এই পার্বণ চূড়ান্ত রূপ পায় জ্যৈষ্ঠ মাসের বারো দিনে। এ সম্পর্কে রোহিনী পার্বণকে জড়িয়ে বারুণী পরব সম্পর্কে একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে । প্রবাদটি হল –

বারো দিনে বারুণী ,

তেরো দিনে রোহিনী

অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসের বারো দিনে বারুণী-পার্বণ এবং তেরো দিনে রোহিনী পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়।  ‘ বারুণী ‘ শব্দটি এসেছে সম্ভবত ‘ বারণ ‘ ( নিষেধ ) শব্দ থেকে। ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ – এই তিন মাসে পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের পর্ণমোচী গোত্রীয় উদ্ভিদের নতুন পাতা, কুঁড়ি, শাখা -প্রশাখা ইত্যাদি জন্মায়। এই অঞ্চলের শাল, পিয়াল, মহুল, হরীতকী, আমলকি, বহেড়া, অর্জুন, পলাশ ইত্যাদি স্বাভাবিক উদ্ভিদ শীতকালে পাতা ঝরিয়ে বসন্তের আগমনে নতুন সমারোহে জেগে ওঠে। আম গাছে নতুন মুকুল আসে, পলাশ গাছ রঙ্গিন ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে বসন্তকে রাঙিয়ে তোলে, শাল গাছ কচি পাতায় নব যৌবন লাভ করে। প্রকৃতি পূজারী এই অঞ্চলের কৃষকেরা প্রকৃতির সঙ্গে এতটাই একাত্মতা অনুভব করে যে জীবন জীবিকার টানেও এই সময় কোন গাছ কাটে না। বারুণী উৎসবের তাৎপর্য এটাই যে সর্বপ্রাণবাদী (Animist ) এই  অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসীদের কাছে এই সময় গাছ তথা যেকোনো ধরনের উদ্ভিদ কাটা বারণ। এই  কৃষকেরা প্রাচীনকাল থেকেই পরিবেশ সম্পর্কে যে কতটা সচেতন বারুণী পার্বণের প্রচলন থেকেই তা বোঝা যায় বর্তমানে পরিবেশ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে এই উৎসবটি আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

মাদল টাঙা পার্বণ : 

রোহিনী পার্বণ (১৩ ই জ্যৈষ্ঠ ) পার হওয়ার পর জ্যৈষ্ঠ মাসেই আসে ‘ মাদল টাঙা পার্বণ ‘। যেহেতু রহিনালি বতরে ( রোহিন পার্বণ অর্থাৎ ১৩ই জ্যৈষ্ঠ পরবর্তী সাত দিন বীজ বপনের অনুকূল অবস্থাকে ‘রোহিনালি বতর ‘বলে ) এই অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসী কৃষকেরা পুরোদমে চাষের কাজে অর্থাৎ বীজতলা তৈরি বীজ বপন করা ইত্যাদি কাজে নেমে পড়ে। তাই এবার গান-বাজনা বন্ধ রেখে মাদল তুলে রাখতে হবে। বাঁধনা পরব, মকর পরব, চৈত,-গাজন, চড়ক পূজা , ছাতুপরব , ভক্তা ঘুরা ইত্যাদি পরবে নাচ গানের আসরে অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র হল মাদল । মাদলের বোল- এ এই অঞ্চলের মানুষদের মন- হৃদয় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে।

নাচ-গান এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনে এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে বলা হয় – এরা হাঁটলেই তা নাচ হয়ে ওঠে, কথা বললেই তা গান হয়ে ওঠে। করম, জাওয়া, ভাদু, টুসু ,বাঁধনা, সহরায়, গাজন প্রভৃতি পরবে এই অঞ্চলের মানুষ মেতে থাকে। এখানে  রুক্ষ ও অনুর্বর ভূপ্রকৃতি হলেও কৃষিকাজে ই মানুষের প্রধান জীবিকা। এই অঞ্চলে আমন ধানের চাষই প্রধান। তাই রোহিনি পার্বণের পর পরে পুরোদমে কৃষিকাজ শুরু হয়ে যায় বলে এখানকার কৃষকেরা ঘরে মাদল টাঙিয়ে রেখে দেয় অর্থাৎ কৃষিকাজের ব্যস্ততার জন্য আর মাদল বাজানো সম্ভব হবে না। এই মাদল টাঙা বিষয়টিও ক্রমে এই অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসী কৃষকদের জীবনে একটি লোকাচারে পরিণত হয়েছে। মাদল আবার নামানো হবে ভাদ্র মাসে ভাদুরিয়া ঝুমুর গাইবার জন্য, যার ব্যবহার চলতে থাকবে রোহিনী পার্বণ পর্যন্ত। 

মানভূমের কৃষিকেন্দ্রিক প্রায় সমস্ত পার্বণকেই বলা যায় পরিবেশবান্ধব । আত্মকেন্দ্রিক,  স্বার্থমগ্ন, ভোগলিপসু তথাকথিত সভ্য মানুষদের তুলনায় মানভূমের গরিব- গুর্বো, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলি পরিবেশ রক্ষায় অনেক বেশি সচেতন ও বিবেচনা বোধ সম্পন্ন – তা মানভূমের পরব- পাইলগুলির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণেই বোঝা যায়।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Renewable Energy: জাপানি প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির প্রস্তাব করেছেন

উত্তরাপথ: সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সাথে নবায়নযোগ্য শক্তিতে (Renewable Energy) দেশের উন্নত প্রযুক্তি ভাগ করার প্রস্তাব করেছেন। মূলত  জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে । সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘদিন ধরে তাদের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদের জন্য পরিচিত, যা তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে উভয় দেশ তাদের কার্বন পদচিহ্ন (Carbon Emission) কমাতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের শক্তির উৎসগুলির পরিবর্তনে আগ্রহী .....বিস্তারিত পড়ুন

Skin Ageing: ত্বকের বার্ধক্যের জন্য একটি প্রোটিন দায়ী বলছেন বিজ্ঞানীরা

উত্তরাপথ: ত্বকের বার্ধক্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা আমরা বড় হওয়ার সাথে সাথে ঘটে থাকে,এক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তাদের মধ্যে, সাম্প্রতিক গবেষণায় ত্বকের বার্ধক্যে অবদান রাখার ক্ষেত্রে IL-17 নামক প্রোটিনের ভূমিকার উপর বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন। IL-17, একটি প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন ,যা ইমিউন প্রতিক্রিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এখন আমরা ত্বকের বার্ধক্যের ক্ষেত্রে IL-17 প্রোটিনের কি এবং ত্বকের উপর এর  প্রভাব সহ ত্বকের যত্ন এবং অ্যান্টি-এজিং চিকিৎসার সম্ভাব্য প্রভাবগুলি অন্বেষণ করব। .....বিস্তারিত পড়ুন

SAFF Final: কুয়েতকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন ভারত

উত্তরাপথ: SAFF Final (সাফ) ফুটবলের শিরোপা হাতছাড়া করেনি এবারও ভারত। শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শেষে শিরোপা নিজেদের কাছেই রেখে দিল Blue Tigers -রা। এই নিয়ে রেকর্ড ৯ম বার এই শিরোপা নিজেদের কাছে রাখল সুনিল ছেত্রীরা। টাইব্রেকারে তারা কুয়েতকে হারিয়েছে ৫-৪ ব্যবধানে । তবে এই জয় খুব সহজে পায়নি সুনিল ছেত্রীরা। বেঙ্গালুরুর শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে কুয়েতের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে শিরোপা দখলে নিল ভারত। নির্ধারিত সময়, অতিরিক্ত সময় অতঃপর টাইব্রেকার; তবুও নিষ্পত্তি হয়নি শিরোপার। অবশেষে ভারত শিরোপা বুঝে পায় সাডেন ডেথে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top