Indian Astronomy: ভারতবর্ষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা (প্রথম কিস্তি)

ড. সায়ন বসু*

IUCAAতে অবস্থিত আর্যভট্টের মূর্তি| ছবি- ওয়েবপেজ

আজ যখন আমরা জেমস ওয়েব রেডিও টেলিস্কোপ বা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া কয়েক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোনও তারা বা নক্ষত্রপুঞ্জের ছবি দেখতে পাই বা হালফিলের ইভেন্ট হরিজন টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া কৃষ্ণগহ্বরের ছবি দেখি তখন অজান্তেই ভুলে যাই যে ভারতবর্ষ একসময় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় পথ দেখিয়েছিল। একটু খুঁজলে দেখা যাবে যে ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয় সিন্ধু সভ্যতার সময়ে বা তারও আগে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে ঋকবেদে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ – ১১০০) জ্যোতির্বিজ্ঞানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋকবেদে দেখা যায় যে এক বছরকে ৩৬০ দিনে ভাগ করা হয়েছে যেখানে ১২ মাস এবং প্রত্যেক মাসকে আবার ৩০ দিনে ভাগ করা হয়েছে। জ্যোতিষ বেদাঙ্গতে দেখা যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের উল্লেখ আছে যা কিনা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ এর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

যথাযতভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা শুরু সিদ্ধান্তিক যুগে (৫০০ – ১৪০০ সাল) যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাবনাগুলোকে বেদ থেকে আলাদা করে একটা নতুন দিকের উন্মোচন করা হল। সিদ্ধান্তিক যুগের সব থেকে বড় এবং মূল্যবান প্রাপ্তি হল বেশ কিছু বই বা গ্রন্থ যাদের একসাথে সিদ্ধান্ত বলা হয়| এই বইগুলিতেই পাওয়া যায় সৌরবৎসর, অয়নকাল, বিষুবকাল, চাঁদের  সময়কাল, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ সাথে গ্রহদের কক্ষপথ সম্বন্ধে ধারনা। প্রথম শতাব্দীতেই ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা প্রস্তাব রেখেছিলেন যে সমস্ত তারারাই সূর্যের মতো তফাত হল যে অন্যান্য তারারা সূর্যের তুলনায় বহু দূরে অবস্থিত। এই সময়ে তাঁরা এটাও বুঝতে পারেন যে আমাদের পৃথিবী গোলাকার এবং জানতে পারা যায় যে তাঁরা এর পরিধি মাপারও চেষ্টা করেন।

এই সিদ্ধান্তিক যুগেই আমরা পাই ভারতবর্ষের তৎকালীন সময়ের সেরা তিন জ্যোতির্বিদকে যারা হলেন, আর্যভট্ট, বরাহমিহির এবং ব্রহ্মগুপ্ত দুর্ভাগ্যবশত আর্যভট্টকে এখন অনেক মানুষ চিনলেও বাকি দুজনের নাম এবং তাঁদের অবদান সম্বন্ধে বেশিরভাগ মানুষ কতোটুকু জানেন সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। শুরু করা যাক এই তিনজনের কথা। 

আর্যভট্টকে ভারতবর্ষের প্রথম গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ বলে ধরা হয় যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারনাগুলোকে অঙ্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। অনুমান করা হয় তিনি ৪৭৬ সালে পাটলিপুত্রে (বর্তমানে পাটনা) জন্মগ্রহণ করেন।তিনি Heliocentric মডেলেরও প্রস্তাব করেন যেটি অনুযায়ী সূর্য আমাদের মহাবিশ্বের মাঝখানে অবস্থিত এবং পৃথিবীসহ অন্যান্য সব গ্রহ সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। সাথে তিনি এও বলেন যে চাঁদ, সূর্যের আলোয় আলোকিত। তিনি আরও একটি প্রস্তাবে উল্লেখ করেন যে আকাশ কখন ঘূর্ণায়মান নয়, পৃথিবী ঘূর্ণায়মান। পৃথিবী যে ঘূর্ণায়মান এটি পরবর্তীকালে কোপারনিকাসও বলেন। তার গবেষণার মধ্যে তিনি গণিত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সূর্য এবং চন্দ্রগ্রহণ আগে থেকে বলা সম্ভব যা কিনা পরবর্তীকালে ইউরোপে সমাদৃত হয়। তাঁর লেখা বই “আর্যভাটিয়া” ত্রয়োদশ শতকে লাতিনে অনূদিত হয়। এই বই থেকে ইউরোপিয়রা বেশ কিছু বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন যেমন, কি ভাবে গোলকের আয়তন বা ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা সম্ভব বা কি ভাবে বর্গমূল বা ঘনমূল নির্ণয় করা সম্ভব। 

বরাহমিহিরের জন্ম উজ্জয়িনীতে। ওনার সবথেকে উল্লেখযোগ্য অবদান হল পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা যার মধ্যে তিনি সূর্য-সিদ্ধান্ত, রমাক-সিদ্ধান্ত, পৌলিসা-সিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠ-সিদ্ধান্ত এবং পএইতামাহ-সিদ্ধান্ত এই পাঁচটি গ্রন্থকে একসাথে লিপিবদ্ধ করে একটি গ্রন্থ লেখেন যা কিনা পরবর্তীকালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। পঞ্চসিদ্ধান্তিকাতে তিনি গ্রহের গতি, কসমোলজি নিয়েও লেখেন। তাঁর অন্যতম অবদান হল নিখুঁত গাণিতিক ফর্মুলা দিয়ে সূর্য এবং চন্দ্রগ্রহণের সময় বের করা। 

ব্রহ্মগুপ্ত ছিলেন সিদ্ধান্তিক যুগের আরও এক খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। উনি সপ্তম শতকে রচনা করেছিলেন ব্রহ্মপুতসিদ্ধান্ত যা গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে খুলে দিয়েছিল এক নতুন দিগন্ত| সেই যুগের অন্য সব জ্যোতির্বিদদের মতো উনিও প্রস্তাব এনেছিলেন যে পৃথিবীর আকার গোলাকার সাথে উনি পৃথিবীর পরিধি মাপার চেষ্টাও করেছিলেন গণিতের সাহায্য নিয়ে। ওনার গণনা অনুযায়ী ব্রহ্মগুপ্ত বলেছিলেন যে পৃথিবীর পরিধি ৩২,০০০ কিলোমিটার যা কিনা সঠিক মাপের (৪০,০৭৫ কিলোমিটার) বেশ কাছাকাছি। 

সিদ্ধান্তিক পরবর্তী যুগেও ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা এবং গবেষণা এগিয়ে গিয়েছিল যদিও এবার ইসলামিক প্রভাব এলো এবং সাথে গ্রীকদের অনেক গ্রন্থ যা অনুবাদ করা হয়েছিল আরবি ভাষাতে। এই সব কিছুর সাথে ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় এলো এক নতুন যুগ যা “যিজ যুগ” (Zij era) নামে পরিচিত। “যিজ যুগ” এবং তারও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাতে কি কি পরিবর্তন এসেছিল সেই সব কিছু আসছে দ্বিতীয় কিস্তিতে।

* লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক।

যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za

এই লেখকের অন্যান্য প্রবন্ধ:  চাঁদের ভবিষ্যৎ, মহাকাশের জঞ্জাল, মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে “ফেলুদা” যখন দক্ষিণ আফ্রিকা, কৃষ্ণগহ্বরের “ছায়া” ও “ছবি”

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top