প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ এই সবে দুর্গা পূজো পেরোলো । সঙ্গে কালী পূজো, দীপাবলিও । আর এমন সব দিনে কালী পটকা, রসবাতি,তারাকাঠি ছাড়া কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হাউই বা দোদমার সঙ্গে তো আমাদের শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হাল আমলের পপ অথবা রঙমশালের কথা তো ছেড়েই দিলাম। যদিও শব্দ আর বায়ু দূষণের হাত থেকে বাঁচতে এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো! তবু ভূত চতুর্দশীর রাত্রি পেরিয়ে দীপাবলীর আলো আর আতশবাজির রোশনাই অমাবস্যার অন্ধকারকেও এক ভালোলাগায় পরিণত করে।
কার্তিক মাসে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য করে আমরা যেমন আকাশ প্রদীপ আর চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালি, প্রায় দুই হাজার বছর আগে সাং রাজাদের আমলে চীন দেশে অনেকটা তেমনই বিশ্বাসেই ভূত প্রেত আর দুষ্ট আত্মাদের তাড়াতে আতশবাজী পোড়ানো শুরু হয়। তার মানে দাঁড়াল এই যে, বাজির জন্ম কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী চীনেই।
আতশবাজির জন্ম বা আবিষ্কার নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেন। কেউ বলেন এটা একটা দুর্ঘটনার ফল। আবার কেউ বলেন শুরুর দিকে অ্যালকেমিস্টদের এক চোখ ধাঁধানো আবিষ্কার হল আতশবাজী। সে যাই হোক এই আলোর ফুলকি কিন্তু চীন দেশ ছাড়িয়ে তার কেরামতি দেখাচ্ছে সারা বিশ্ব জুড়ে। সে বিয়ে-শাদি হোক বা কোনও আনন্দ উৎসব, স্বাধীনতা দিবস পালন হোক বা নববর্ষ। আতশবাজির রোশনাই ছাড়া তা যেন অসম্পূর্ণ লাগে । এবিষয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা একমত। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আতশবাজী মানুষের মনে ও মস্তিষ্কে এক আনন্দ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । ক্ষণিকের জন্য হলেও আজকের এই অবসাদের যুগে তাই বা কম কিসের!
এবার একটু আতশবাজির বিশ্বজয়ের কথায় আসি । আনুমানিক ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে চীনে সাং রাজবংশের রাজত্বকালে লি তিয়ান নামে এক ব্যক্তি লিউ ইয়াং নামের ছোট্ট এক শহরে বাস করতেন। কথিত আছে, সে সময় চীনের মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে আর অমরত্ব লাভের আশায় বাঁশের চোঙায় বারুদ ভরে প্রথম আতশবাজির প্রদর্শন করেন তিয়ান। আলো আর শব্দের এমন মেলবন্ধন দেখে স্বভাবতই মানুষ যথেষ্ট আশান্বিত হয়। এরপর কাগজের নলে ভরে বারুদের কেরামতি দেখানো শুরু হয় চীনের বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে। কিন্তু এর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যবহার শুরু হয় যখন চীন,যুদ্ধে প্রথমবার এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কামানের মাধ্যমে রকেটের প্রয়োগ শুরু করে ।
এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। আতশবাজির ব্যবহার চীন থেকে আরবদের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে যখন ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছায় তখনও এর সাদা মাটা রূপই বজায় ছিল । অর্থাৎ এতে কমলা ছাড়া কোনও রঙের ব্যবহার ছিল না। প্রায় দুহাজার বছর ধরে আতসবাজির সেই রূপের কোনও পরিবর্তন হয়নি। যুদ্ধের কাজে বা গোপন সংকেত হিসেবেই এর ব্যবহার বেশি হতো। এরপর ধীরে ধীরে এতে স্ট্রনমিয়াম ও বেরিয়ামের ব্যবহারে রঙের বাহার বাড়তে থাকে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আতসবাজির প্রদর্শন জনপ্রিয় হতে লাগে। ১৪৮৬ সালে ব্রিটেনের রাজা হেনরী সপ্তম ও এলিজাবেথের বিয়েতে লন্ডনে যে রাজকীয় আতশবাজির প্রদর্শন হয় তা সারা পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিয়েছিল। এমনকি ব্রিটেনে আতশবাজি দেখানোর জন্য তখন ফায়ার মাস্টারদের রীতিমত বেতন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হত। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে এঁরা গাছের পাতা দিয়ে সারা শরীর ঢেকে রাখতেন বলে তাঁদেরকে গ্রীন ম্যান নামেও ডাকা হত । অর্থাৎ সেই সময় এদের কাজ মোটেও সহজ ছিলো না। জীবন হাতে নিয়ে এঁরা মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা করতেন । আজও অবশ্য আতশবাজির প্রদর্শনীর সময় ছোট বড় দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। এর মধ্যে সেই ছোট্ট আলোর ফুলকি বৃহৎ রূপ নিয়ে বণিকদের হাত ধরে যখন আমেরিকায় পৌঁছল তখন থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
উনিশ শতকে পটাশিয়াম ক্লোরেটের জাদুতে লাল নীল রঙের ফোয়ারা আতশবাজির সংজ্ঞাই বদলে দিলো। এখন আতশবাজির যে চোখ ধাঁধানো রূপ আমরা দেখি তার সূচনা ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে। ১৯৭৬সালে ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যে আতশবাজির বাহার মানুষ দেখেছিল তা বহু যুগ ধরে উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে। এখনও পর্যন্ত এই রীতি চলে আসছে। সবচেয়ে আতশবাজি আমদানি করে আমেরিকা আর রপ্তানী করে চীন।
ভারতে ঠিক কবে থেকে আতশবাজির প্রচলন শুরু হয় তা নিয়ে অবশ্য ঐতিহাসিকরা ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। তবে দীপাবলিতে প্রদীপ জ্বালানোর রীতি বেশ প্রাচীন। সুতরাং দীপাবলি আর আতশবাজি নিশ্চয়ই সমার্থক নয়। আব্দুর রাজ্জাকের বিবরণীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় দেবরায় এর আমলে মহানবমীর রাতে বাজি ফাটানোর উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ ও পিছিয়ে ছিলেন না। অর্থাৎ এখানেও সেই চির প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাজস্থানে বিবাহবাসরে আতশবাজি প্রচলন ছিলো বা আজও আছে। মুঘল যুগে আতশবাজি ব্যবহারে বেশ রমরমা ছিলো। বিশেষত দীপাবলির রাতে সুলতানরা কেল্লা থেকে ” জশন এ চিরাঘন” দর্শনের আনন্দ নিতেন, যার প্রমাণ বহু মিনিয়েচার পেইন্টিং এ পাওয়া যায়। তখনকার দিনে আতশবাজি ছিল অভিজাতদের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। তখনও বাজি বিদেশ থেকেই আমদানি করা হতো। ভারতে বাজি তৈরীর প্রচেষ্টা অনেক পরে শুরু হয়। উনিশ শতকে কলকাতায় প্রথম বাজি কারখানা তৈরী হয়। বর্তমানে তামিলনাড়ুর শিবকাশীতে আতসবাজির বৃহত্তম নির্মান কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
আতশবাজির এতো বৈচিত্র্যময় যাত্রার অবশ্য কোনও সুগঠিত দলিল দস্তাবেজ নেই। লোকমুখে প্রচলিত গাথা অনুসারে এর ইতিহাস জানা যায়। তবে যাঁরা এর বর্ণ বা শব্দে একান্তই কোনও আনন্দ অনুভব করেননা তাঁরা কিন্তু জীবনের এক অনবদ্য আনন্দ থেকে বঞ্চিত একথা মানতে হবে। আতশবাজির সাবধানতা পূর্বক ব্যবহার ও পরিবেশ বান্ধব প্রকৃতির উন্নতি হোল ভবিষ্যতে এর আরো শ্রীবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন
স্বপ্নপূরণ না হলেও জ্যাভিলিনে সোনা জিতলেন নীরজ
উত্তরাপথ: দোহায় ডায়মন্ড লিগে জ্যাভিলিনে সোনা জিতলেন নীরজ চোপড়া কিন্তু তার জ্যাবলিনে ৯০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করার স্বপ্নপূরণ হল না । দোহায় তার জ্যাভিলিন থামল ৮৮.৬৭ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। গতবছরও এই লিগে প্রথম পদক জিতেছিলেন নীরজ। দোহার সুহেম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে প্রথমবার জ্যাভলিন ছুড়েই চমক দেন নীরজ। প্রথমবারেই তার জ্যাভলিন চলে যায় ৮৮.৬৭ মিটার। ২০২২ সালে জুরিখের ডায়মন্ড লিগে সফলতা হয়েছিলেন নীরজ এবং টোকিও অলিম্পিকে সোনা জিতেছিলেন তিনি। তার লক্ষ্য ছিল ৯০ মিটারের গণ্ডি পেরনোর কিন্তুসেই লক্ষ্য .....বিস্তারিত পড়ুন
শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তি: স্লিপ অ্যাপনিয়া দীর্ঘ কোভিড ঝুঁকির সাথে যুক্ত
উত্তরাপথ: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের রিকভার ইনিশিয়েটিভ এবং এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোন হেলথের একটি সমীক্ষা অনুসারে কোভিড পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্কদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষণগুলির জন্য ১২-৭৫% কোভিডের ঝুঁকি বেড়েছে, যা সরাসারি স্লিপ অ্যাপনিয়ার সঙ্গে যুক্ত । অথচ শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি প্রায় নেই । .....বিস্তারিত পড়ুন
রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে ২২ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন মোদী
উত্তরাপথ: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামী মাসের ২২ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যোগ দিতে।এই নৈশভোজে মোদীকে রাষ্ট্রপতি জো বিডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বিডেন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।এই সফরে মূলত দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হবে এবং একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। MEA বলেছে যে মোদী এবং বিডেন G20 সহ প্লুরি-পার্শ্বিক এবং বহুপাক্ষিক ফোরামে ভারত-মার্কিন সহযোগিতা জোরদার করার উপায়গুলিও .....বিস্তারিত পড়ুন
ওসাকা ক্যাসেল – ঐতিহাসিক এক দুর্গ ভ্রমণ
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী, টোকিও, জাপান: কেল্লা বা দুর্গ এই নাম শুনলেই কল্পনায় ঐতিহাসিক ঘটনায় মোড়া রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণক্ষেত্রের দৃশ্য ভেসে ওঠে। জাপানে এমন শতাধিক দুর্গ আছে যার সৌন্দর্য আজও যেমন বিমুগ্ধকর ঠিক তেমনি তার অতীতের সাদা কালো দিনের গল্প দর্শনার্থীকে অবাক করে। প্রাচীনকাল থেকেই জাপানে দুর্গ তৈরি হয়ে আসছে, তবে ইতিহাস বলছে দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন ও গৃহ যুদ্ধের কারণে ১৫ শতকের গোড়া থেকে দুর্গের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়। সামন্ত যুগে, জাপান বেশ কিছু ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রায়ই যুদ্ধ ঘোষণা করত এবং .....বিস্তারিত পড়ুন