দিলীপ গায়েন
ব্রিটিশ আমলে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি ও খ্রিস্ট ধর্ম ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছিল খ্রিস্টান ধর্মের যাজক এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির সহায়তায়। এমনতর অবস্থায় ভারতীয়রা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করেছিল। যাকে ইতিহাসের ভাষায় বলা হয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ আন্দোলন।
রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, দয়ানন্দ সরস্বতী, আত্মারাম পাণ্ডুরাম, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, কেশব সেন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অনুকূল ঠাকুর, বালক ব্রহ্মচারী, ভারত সেবাশ্রম, তিলক, মালব্য, হিন্দু মহাসভা—এঁরা সকলে মিলে বৈদিক ধর্মের পুনর্জাগরণ করলেন হিন্দু ধর্মের নামে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁরা সকলে অতীত ইতিহাস তুলে ধরলেন। বেদ গীতা উপনিষদ পুরাণ রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি। তাঁরা কেউ অতীত ইতিহাস সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করলেন না।
একইভাবে ব্রিটিশ আমলে মুসলিম বা ইসলাম ধর্ম পরাধীনতার স্বীকার হতে থাকে। তখন তাঁরাও ফরাজী, ওহাহাবী, আলীগড় আন্দোলন, কোরআনের নতুন ব্যাখ্যা মারফত অতীত ইতিহাস সামনে তুলে ধরে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি বাঁচানোর চেষ্টা করলেন।
ভারতের মূলনিবাসী সমাজ সুদূর অতীত ভারতে সিন্ধু হরপ্পাকালে সনাতন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরে তারই অভিন্ন রূপ বৌদ্ধ-জৈন ইত্যাদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিশেষ করে ষোড়শ মহাজন পদের পনেরটি মহাজন পদ ছিল সনাতন তথা বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। অশোকের নেতৃত্বে ভারত সহ বিশ্বে বুদ্ধের আদর্শ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বৈদিক ধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গের হরিচাঁদ -গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে অতীত ভারতের সেই সনাতন তথা বৌদ্ধ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ হয়েছিল নব রূপে মতুয়া নামে। তারক সরকার তাঁর শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থে এবং মহানন্দ হালদার তাঁর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত গ্রন্থে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসঙ্গ লিখেছেন। বলতে হয় এই কাজটি ব্রাহ্মণ ও মুসলিম আন্দোলনের নেতারা বুদ্ধের কথা সামনে আনেননি। ব্রাহ্মণ সমাজের নেতারা বুদ্ধকে হিন্দুভুক্ত করার চক্রান্ত করেছেন। তারক সরকার ও মহানন্দ হালদার বুদ্ধের সঠিক ব্যাখ্যা করে সনাতন ধর্মের উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ, মতুয়া আন্দোলনের এই দুই মহাকবি তাঁদের গ্রন্থে বুদ্ধের প্রসঙ্গ সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। ব্রাহ্মণ ও মুসলিম যেমন তাঁদের অতীত ইতিহাস সামনে এনেছেন তদ্রূপ তারক সরকার ও মহানন্দ হালদার মূলনিবাসীদের অতীত বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখ করেছেন তাঁদের বইয়ে।
কিন্তু বর্তমান ঘটনা হলো, মতুয়া প্রসঙ্গে আজকালকার আলোচনা বা লিখিত গ্রন্থে মূলনিবাসী সমাজের অতীত বৌদ্ধ প্রসঙ্গের উল্লেখ করা হচ্ছে না। যেটা করে গেছেন তারক সরকার ও মহানন্দ হালদার। এর ফলে মতুয়াদের মধ্যে একটি ধারণা হয়েছে বৌদ্ধ এর সঙ্গে মতুয়ার কোনো সংযোগ নেই। দুটো স্বতন্ত্র ধর্ম।
এদিকে আম্বেদকর আবার বৌদ্ধ ইতিহাস সামনে এনেছেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্ম ও সংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে আম্বেদকরের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংযুক্তি ঘটানো দরকার। সেই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে বলে মনে হয় না।
এর ফলে বৌদ্ধ-মতুয়ার তফাৎ সৃষ্টি হচ্ছে এবং হরিচাঁদ-আম্বেদকরেও তফাৎ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মূলনিবাসী সমাজের আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং আন্দোলনে সংঘবদ্ধ রূপ দেখা যাচ্ছে না।
তাই আমার বিনীত নিবেদন, আসুন ব্রাহ্মণ ও মুসলিম সমাজ যেভাবে তাঁদের অতীত ইতিহাস চর্চা করে নিজেদের আইডেন্টিটি রক্ষা করেছে ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তদ্রূপ এসসি ,এসটি ওবিসি মূলনিবাসী সমাজেও সেই ঐক্য স্থাপন করা হোক।
বৌদ্ধ-মতুয়ায় তফাৎ দেখিয়ে কিংবা হরিচাঁদ-আম্বেদকরে তফাৎ দেখিয়ে আর যাই হোক মূলনিবাসী আন্দোলন কোনোদিন সফল হবে না। হতে পারে না।
আরও পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন
Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ
উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন
সম্পাদকীয়- রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র
সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন