কেনো লিখি কী লিখি

জীবনকুমার সরকারঃ কলম যখন এই শিরোনামের কাছে কিছু জানতে চায়, তখন অনেক বিস্তর কথা উঠে আসতে চায়। এত কথা বিস্তার করাও কঠিন।
২০২৫ সালের এই সময়েও দেখছি মানুষের মধ্যে তুমুল নিস্ক্রিয়তা আর জিজ্ঞাস্যহীনভাবে চলার প্রবণতা। এই ঝোঁক দিনের পর দিন মানুষকে এক না–পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে এই আবহের মধ্যে দাঁড়িয়ে লেখার মতো একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ক্রিয়াপদের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা ধরে রাখা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।
সোস্যাল মিডিয়ায় আত্মমগ্ন থাকা মানুষের কাছে বর্তমানে লেখার মতো তত্ত্বগত ব্যাপারটা হাস্যকর। একইসঙ্গে পড়ার মতো তাৎপর্যপূর্ণ কাজটিও তাদের কাছে পণ্ডশ্রম ও নিরর্থক কাজ বলেই মনে হয়।
তবে কেনো লিখি এবং কী লিখি — এই প্রশ্ন
আমাকেও নানাভাবে জর্জরিত করে। নির্মাণে বিনির্মাণে এই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজি। তখনই চরম দায়বদ্ধতা এসে ধুন্দুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়। তখন কলমই হয়ে ওঠে বাঁচার একমাত্র হাতিয়ার। তখনই লিখি। আরও লিখি। এবং লিখি।
আমার চারপাশে ঘটে যায় নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। ঘটে থাকে অনেক অমানবিক ঘটনা। তবু আত্মপ্রতারণায় বেশিরভাগ মানুষ ঘটে যাওয়া অনেক খারাপ ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য ক’রে বেঁচে থাকছে। দিব্যি ভালো থাকছে। এই ভালো থাকা আমার কাছে অর্থহীন। বিবেকহীন। ফলে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে একেবারেই অক্ষম। এই অক্ষমতার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে সমাজের অপশক্তির সঙ্গে বিরোধ। এই বিরোধিতার মাঠে কোনো সঙ্গী নেই। কোনো হাতিয়ার নেই। নিজেই নিজের সঙ্গী এবং লেখাই একমাত্র হাতিয়ার। আর যুক্তিবাদী মনন সর্বক্ষণের বন্ধু।
আমার চারপাশের অন্ধকারই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। আমি নিজে নিজের জন্য কিছু হয়তো লিখতে পারি না। অন্ধকার প্রবল চিৎকার ক’রে ক’রে
আমাকে আলো দাও। মুক্ত করো রাহুগ্রাস। তখন প্রতিবেশি অন্ধকারের আর্তি আমাকে দিয়ে আলোর
অভিসারের কথা লেখায়। এই তো লিখতে লিখতে মনে পড়লো মুক্তচিন্তার অনন্য প্রজ্ঞা ও কবি হুমায়ুন আজাদের পঙক্তি — “ আমি জানি সবকিছু নষ্টদের
অধিকারে যাবে।” এই সময়ের মধ্যে যাপন করতে করতে বুঝতে পারছি হুমায়ুন আজাদ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর মতো আমিও যখন উপলব্ধি করতে পারি যে, ধীরে ধীরে সমাজের, রাষ্ট্রের সবকিছু
নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে, তখন মোটেই বিবেক আমাকে চুপ থাকতে দেয় না। আমাকে দিয়ে লেখায়। আমি আসলে কী লিখি ? আমি নষ্টদের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ লিখি। নষ্টদের ডানায় রংধনুর মতো সুন্দর পৃথিবীকে অন্ধকারে ডুবতে দিতে চাই না বলে
অবিরাম লেখার মতো পবিত্র কাজের কাছে নতজানু
হয়ে আছি।
আমার লেখায় শিল্প কতটা থাকে জানি না। সেটা বিচার করবেন শিল্পের সমঝদাররা। তবে এটা বলতে পারি, আমার লেখায় নষ্ট আর দানবদের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ থাকে। পণ্যসংস্কৃতির এই দানবীয় মুহূর্তে সবই যেনো অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত। যাবতীয়
মূল্যবোধ চলে গেছে লাশকাটা ঘরে। তবু আমরা বেঁচে
একমাত্র লেখালেখির ভুবনে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ যাই লিখি কেনো; আপাতভাবে আলাদা মনে হলেও আসলে একটা লেখাই লিখে যাচ্ছি ব’লে আমার মনে
হয়। সে লেখার নাম সত্যের অনুসন্ধান। আর সমস্ত পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য
নষ্টদের বিরূদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম।
দিনের পর দিন যেভাবে নষ্ট প্রভুরা প্রবল প্রতাপ সহকারে সবকিছুতেই আধিপত্য বিস্তার করছে, তাতে বারবার ক’রে শঙ্খবাচনের কথা মনে পড়ে — “ আমাদের ডান পাশে ধ্বস/ আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ/ আমাদের মাথায় বোমারু/ পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ/ আমাদের পথ নেই কোনো/ আমাদের ঘর গেছে উড়ে/ আমাদের শিশুদের শব/ ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।” এই অমোঘ সত্যের কিনারে দাঁড়িয়ে আমার মতো সামান্য লিখতে পারা অক্ষম লেখকের কী করার থাকতে পারে? ওই আবার একটাই উত্তর — এই জন্যেই লিখে যাই। বেঁচে থাকবো বলে লিখে যাই। লেখার মতো শক্তিশালী অনেকার্থদ্যোতনাসম্পন্ন কিছু নেই। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উপস্থাপন করতে চাই, লেখার পাশাপাশিই অনিবার্যভাবে উঠে আসে পড়ার কথা। বিশিষ্ট তাত্ত্বিক রোলা বার্ত বলেছেন —” পড়া আসলে এক ধরনের বিশিষ্ট কাজ।” রোলা বার্তের এই কথার তাৎপর্য
আজও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। পারিনি বলেই
আমাদের পড়ার বিষয় নির্বাচনে শুরু থেকেই ফাঁকি থেকে যায়। এইজন্য ‘কেনো লিখি, কী লিখি’এটা যেমন বোঝা জরুরী; একইভাবে ‘কেনো পড়ি, কী পড়ি’ এটাও বোঝা জরুরী।
আসলে সকল পড়াই পড়া নয়, কোনো কোনোটা পড়া। আবার সকল লেখাই লেখা নয়, কোনো কোনোটা লেখা। সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক। একইভাবে সকলেই লেখক নয়, কেউ কেউ লেখক। সত্যের এই দ্বিরালাপ নিয়েই আমার ‘কেনো লিখি, কী লিখি’ গড়ে উঠেছে।
ছদ্মবেশি এই সময়ে কোনটা প্রকৃত সত্য, আর
কোনটা মিথ্যে ; বুঝে উঠতে না উঠতেই আরও একটি
উৎপাদিত মিথ্যে এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায় কৃষ্ণবিবরে। এই তুমুল আচ্ছন্নতায় মুড়ে যাচ্ছে আমাদের চতুর্দিক। কোনটা সময়ের মুখ, আর কোনটা সময়ের মুখোশ — এই সত্য খোঁজার অভিসারেই আমার জীবন পুড়ে যাবে জানি। কারণ, লেখকের কাজও যে অবিরাম খোঁজা। জগৎ ও জীবনকে খনন
করা। এই কাজ যিনি নিরলসভাবে ক’রে যেতে পারেন, তিনিই লিখতে পারেন কবিতা–গল্প–উপন্যাস ইত্যাদি। সৃষ্টির দ্যোতনা বড়ো মারাত্মক! সৃষ্টির
দ্যোতনায় যেমন আগুন জ্বলে মানুষের মধ্যে, তেমনি আবার তার দ্যোতনায় মানুষ ঘুমিয়েও থাকে। এই প্রসঙ্গে আবার সেই অতি পরিচিত বাচনের কাছে ফেরা যাক — “ কত রবি জ্বলে রে, কেবা আঁখি মেলে রে!” ঠিক তাই। লিখিয়েরা কত ধরনের মননশীল সমৃদ্ধ লেখাই না লিখছেন! কতজন পাঠক তার হদিশ
রাখেন?
আমি কি আসলে সাহিত্য লিখি? জানি না। তবে কিছু তো লিখি। বোধহয় আমি এটাই লিখি — যে জীবনকে প্রতিদিন বয়ে যেতে দেখি, তারই কিছু হিসেব মেলাই। অঙ্ক করি। বিশ্বায়নের অন্তর্জালে স্বেচ্ছাবন্দি এই সময়ে আগে বুঝে নিতে হবে কাকে বলে লেখক? বাজার অর্থনীতির কাছে শিল্পজগৎও কেমন যেনো অসহায়। ফলে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে আর লেখা নয়, গুরুত্ব পাচ্ছে লেখক বা ব্যক্তি। বস্তুবিশ্বের চিন্তাজগতের সীমারেখা বারবার বদলে গেলেও সত্যের পরিসরকে নিষ্কণ্টক করার গুচ্ছ গুচ্ছ
অভিপ্রায় নিয়ে লিখি।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top