জানুন ২০২৩ সালের জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক ডঃ শীলা অসোপা’র কথা

ডঃ শীলা অসোপা শ্যাম সদন বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যোধপুরের অধ্যক্ষা।ছবি সৌজন্যে- টুইটার

উত্তরাপথঃ ডঃ শীলা অসোপা, শ্যাম সদন বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যোধপুরের অধ্যক্ষা, তিনি ১৭ বছর ধরে স্কুলের বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন।তাঁকে শিশুদের শেখানোর নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, স্কুলের অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং উদ্ভাবনের জন্য ২০২৩ সালের জাতীয় শিক্ষক পুরস্কারে পুরুস্কৃত করা হয়।  

ডঃ অসোপাকে, যোধপুরে শ্যাম সদন, সরকারি বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, ১০ মাস আগে বদলি করা হয় । সেই সময় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ে মাত্র দুটি কক্ষ ছিল।মেয়েরা টিনের চালা দিয়ে তৈরি ঘরে পড়াশোনা করত।  ঘর কম থাকায় গাছের নিচেও ক্লাস হত । তার কথায় ,সেই সময়টা বাচ্চাদের পড়াশুনা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় কেটেছে । এরপর টিনের চালা দিয়ে তৈরি কক্ষে কাঠের পার্টিশন দিয়ে ৬টি কক্ষ তৈরি করা হয়। একইভাবে, একটি হলকে ৪ টি কক্ষে এবং বারান্দাটিকে দুটি কক্ষে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।  এভাবে ১২টি কক্ষ প্রস্তুত করা হয়।

এরপর বাচ্চাদের পড়াশুনার সুবিধার জন্য টিনের চালায় নির্মিত কক্ষে প্রজেক্টর, টিভি, কুলার ফ্যান ও চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়।রাজস্থানের এটাই প্রথম সরকারি স্কুল যেখানে প্রতিটি ঘরে কুলার লাগানো আছে।এই কারণে বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি বেড়েছে।কোনো শিশুই তার ক্লাস মিস করতে চায় না।শিশুরা বুঝতেও পারে না যে তারা টিনের চালা দিয়ে তৈরি ঘরে বসে পড়াশোনা করছে।

 প্রতিটি ক্লাসে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।তিনি জানান, আমি সব সময় বলি যে যে শিশু পড়াশোনা করতে চায়, সে যে কোনও জায়গায় পড়তে পারে।আগে বিদ্যালয়ে ৯০ জন শিশু ছিল বর্তমানে তা বেড়ে ১৬০ জনে উন্নীত হয়েছে।সরকারি বিদ্যালয় হওয়ার কারণে এখানে রিকশাচালক থেকে শ্রমিক সকলের সন্তানরাই আসে।বাচ্চাদের কিউআর কোড সহ বই দেওয়া হয় যাতে তারা বাড়িতেও পড়াশোনা করতে পারে।শিশুরা এর মাধ্যমে ঘরে বসে পড়াশুনা রিভিশন করতে পারে। সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি এই ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা করেছে।

ডঃ শীলা অসোপা এর মতে এখন পর্যন্ত আমাকে ৬টি স্কুলে বদলি করা হয়েছে।শ্যাম সদন স্কুলে আসার আগের স্কুলটিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার কাজ করেছি।আজ আমার কাজে মুগ্ধ হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।এছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও পাওয়া গেছে।সিঙ্গাপুরের কোম্পানি সেটিয়াট প্রাইভেট লিমিটেডও শিশুদের শিক্ষার জন্য সহায়তা দিয়েছে। তার মতে যদি কোনও কাজ সততার সাথে করা হয়,তাহলে অনেক সংগঠন নিজেরাই সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে ।

এর আগে তিনি যোধপুরের একটি স্কুলের ভবন নির্মাণের জন্য জনসাধারণের থেকে ১০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন।২০১৬ সালে যোধপুরের থোবে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যখন তিনি বদলি হয়ে আসেন সেই সময় পুরো বিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। চারটি কক্ষ থেকে স্ল্যাব (সিলিং) খসে পড়ছিল সারা ঘরে ভাঙ্গা ঘরের টুকরো ছিল ছড়ানো । সেই সময় এমন জরাজীর্ণ বিদ্যালয়েও ৪৫০ শিশু লেখাপড়া করত। 

বিদ্যালয়ের এমন বেহাল অবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি একটি নতুন স্কুল ভবন তৈরি করবেন।তারপর দীর্ঘ সংঘর্ষের পর ১ কোটি টাকা ব্যয়ে স্কুলটি রূপান্তরিত হয়েছিলীবং তাঁর সিদ্ধান্ত পূর্ণ হয়েছিল।এই ভবন তৈরিতে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য আসে এবং সাধারণ মানুষও সহযোগিতা করেন।তিনি বলেন আমি সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতাম।লোকেদের কাছে স্কুল ভবনের জন্য সাহায্য চাইতাম।জনসাধারণের সহযোগিতায় ১০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করা গেছিল। যা বিদ্যালয়ের অবকাঠামোতে ব্যয় করা হয়েছে।

এখন সেই স্কুলে সব সুযোগ-সুবিধা আছে।আগে মেয়েরা স্কুলে আসত না।কিন্তু স্কুলের উন্নতি দেখে অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছে।আগে স্কুলে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল না । এরপর স্কুলে মেয়েদের খেলার জন্য ব্যবস্থা করা হয়।  কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পরে, মেয়েরা খেলাধুলায় অংশ নিতে শুরু করে। সেই সময় প্রথমবারের মতো,একটি ভলিবল দল গঠন করা হয়েছিল এবং এই দলটি রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে জিতেছিল।আজ সেসব মেয়ের মধ্যে কেউ কেউ শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরিতেও কাজ করছে।

যোধপুর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ধোয়াতে তিনি শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। সেই সময় খারাপ স্বাস্থ্যর কারণে বিদ্যালয়ে শিশুদের অনুপস্থিতি বেশি ছিল।প্রায় ৫০০০ ছাত্রকে নিয়ে ‘ক্লিন হ্যান্ডস, ক্লিন বডি ক্যাম্পেইন চালান।দেশের প্রথম গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রথমবারের মতো এমন প্রচার চালানোর জন্য ইন্ডিয়া বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর কন্যাদের ডিগ্রি দরকার, যৌতুক নয় এই নিয়ে প্রচার শুরু করেন।এর জন্য তিনি প্রতিটি বাড়িতে যোগাযোগ করতেন এবং মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতেন তাদের অভিভাবকদের।  

তার প্রথম চাকরির পোস্টিং ছিল পিপারে ২০০৬ সালে।যোধপুর থেকে ৬৫ কিমি দূরে । সেখানেও শিশুদের দক্ষতা বোঝার ও উন্নত করার চেষ্টা শুরু করেন।খেলাধুলায় মনোনিবেশ করেন।সেখানকার মেয়েরা খেলাধুলায় রাজ্যস্তরে উঠেছিল। আজ অনেক মেয়ে উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত।কেউ পুলিশে, কেউ খেলায় আবার কেউ শিক্ষকতার পেশায়।সেই সমস্ত মেয়েরা আজও ডঃ শীলা অসোপাকে তাদের রোল মডেল বলে।ডঃ শীলা অসোপার কথায় একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে?

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top