সম্পাদকীয়- আজকের বিশ্বে আরও সান্তা প্রয়োজন দারিদ্র ও বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেবার জন্য

আমরা এমন এক বিশ্বে রয়েছি যেখানে সহিংসতা,দারিদ্র ,বেকারত্ব সহ একাধিক বিষয়ে আমাদের সমাজ দ্বিধা বিভক্ত। সমাজের একটি শ্রেনীর দ্বারা অন্য শ্রেণী নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শিক্ষিত বেকারত্ব ও ক্ষুধার মত বিষয়গুলি বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ,অথচ বিশ্বের কোনও সরকার এই বিষয়ে তাদের ব্যর্থতাকে সহজে মেনে নিতে পারে না।সরকারগুলি অন্তত একটি বিষয়ে একমত হয়েছে তাহল কর্মসংস্থান বলতে শুধু সরকারি চাকরি নয় কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ, একটি সত্য হল যে, বিমুদ্রাকরণের পর লক্ষাধিক লোক চাকরি হারিয়েছে এবং অন্যটি হল নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি শ্লথ হয়ে গেছে, যার কারণে বেকারত্ব আকাশচুম্বী হয়েছে।সেই কারণে আজকের বিশ্বে আরও অনেক সান্তা প্রয়োজন যারা আমাদের মধ্যে আনন্দ এবং ভালবাসা ছড়িয়ে দেবে।

ভারতে বেকারত্বের বর্তমান স্তর কত, তা কিছু গবেষণা ও সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিসের (এনএসএসও) প্রতিবেদনে, যা এই বছরের জুনে প্রকাশিত হয়েছিল, দাবি করা হয়েছিল যে বেকারত্বের হার যা ২০১১-১২ সালে ২.২ শতাংশ ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে ৬.১ শতাংশের রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে আমাদের সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৭.৭০ শতাংশ এবং এই একই বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ২৫ বছরের কম বয়সী শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের (Educated unemployment )হার ৪২ শতাংশের বেশি।২০২৩ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারত ১১১তম স্থানে রয়েছে। ২৮.৭ স্কোর সহ, ভারতে ক্ষুধার মাত্রা রয়েছে যা যথেষ্ট গুরুতর।  

তবে, এই বেকারত্বের হার বৃদ্ধির পিছনে, এনএসএসও বলেছে যে গণনার পদ্ধতির পরিবর্তন একটি বড় কারণ। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবসময় নিরক্ষরদের তুলনায় বেশি, তাই তাদের পরিসংখ্যান বেড়েছে। কিন্তু বেকারত্বের বৃদ্ধি শুধুমাত্র NSSO দ্বারা অনুমান করা হয়নি, গত দুই বছরে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE) দ্বারা পরিচালিত সমীক্ষাও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে। CMIE’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিল ২০১৯ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল সাত শতাংশ। ‘স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০১৮ তেও কিছু অনুরূপ মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছে। এই সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৮ সালে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল পাঁচ শতাংশ, কিন্তু এর মধ্যেও, ১৫ থেকে ২৯ বছরের যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ছিল তিনগুণ বেশি অর্থাৎ পনের শতাংশ পর্যন্ত। এই বয়সের বেকারত্বের সমস্যা শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ছিল।

বেকারত্বের এই পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে যে কেন বেকারত্ব সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয় নয়। এটা সত্য যে বেকার শ্রেণিতে নিবন্ধিত বেশিরভাগ যুবক শিক্ষিত এবং তারা তাদের পছন্দের একটি ভাল চাকরি খুঁজছে এর জন্য তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে  সরকারকে সরাসরি দায়ী করে না। তবে সরকারি চাকরি হ্রাস তাদের জন্যও উদ্বেগের বিষয়।সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষিত বেকার যুবক – যুবতীদের এই ক্ষোভ ভোট বাক্সে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনা । এখনও ভারতের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে কর্মসংস্থান সহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে সরকারের নীতিগুলি সঠিক পথে রয়েছে, তবে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে উদ্বেগ তাদের সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে।

অন্যদিকে কর্মসংস্থানের বিষয়ে শহরের শিক্ষিত যুবকরা নিজেদের পছন্দ সই কাজ পাওয়ার ব্যাপারে গ্রামীণ যুবকদের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে এই পুরো পর্বে সরকার ও শিল্প জগতের উদ্বেগও ভিন্ন ধরনের। শিল্প জগতের থেকে বলা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষিত বেকারদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের শিল্পের জন্য প্রস্তুত না হওয়া। অর্থাৎ, প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও, তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই যা তাদের নিয়োগযোগ্য করে তুলতে পারে। এই কারণে, বাজারে কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, লক্ষাধিক পদ খালি রয়েছে এবং সংস্থাগুলি কাঙ্ক্ষিত যোগ্য তরুণদের সন্ধান করছে।এই সময়ে ‘স্কিল ইন্ডিয়া’-এর মতো একটি উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি যেখানে বছরে প্রায় ৪০ কোটি যুবক- যুবতীদের দক্ষ করে কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু সেটি কিভাবে বাস্তবে স্মভব সেটি স্পষ্ট নয়। আমরা যদি প্রতিবেশী চীনের সাথে এটি তুলনা করি তবে এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে, সেখানে সরকার প্রতি বছর নয় কোটি যুবকদের দক্ষ করার ব্যবস্থা করছে।

এই সমস্যার অন্য দিকটি আরও গুরুতর। এই দিকটি শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মানের সাথে সম্পর্কিত। দেখা যাচ্ছে, শিশু-কিশোররা কোনো না কোনোভাবে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও সেখান থেকে যে ডিগ্রি-ডিপ্লোমা পাবে, তার ভিত্তিতে তারা যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সক্ষম হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এই বিষয়টি স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার নিম্নমানের সাথে সম্পর্কিত। এ কারণেই দেশের ৭৭.৭০ শতাংশ যুবক শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত চাকরির জন্য একটা বড় অংশ এখন প্রস্তুত নয়। স্পষ্টতই, সমস্যাটি বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার মানের সাথে জড়িত যা তাদের একটি ভাল চাকরি পেতে বা তাদের নিজস্ব ব্যবসা স্থাপনে সহায়তা করবে।  

অবশ্যই এই ধরনের ফলাফল উদ্বেগজনক এবং সরকারের উচিত গুরুত্ব সহকারে দেশের চলতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মান সম্পর্কে চিন্তা করা।যাতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষাকে বহন না করে তাদের বাহনে পরিণত করতে পারে এবং এগিয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারে সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ধরনের পার্থক্য এবং ত্রুটিগুলি দূর করাতে পারলে আমাদের সমাজে শিক্ষিত বেকার সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আর তাদের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কোনও সান্তা ক্লজের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না যে তাদের জীবনে আনন্দ ছড়িয়ে দেবে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top