ভেষজ চামড়ার চমক

 প্রিয়াঙ্কা দত্ত : ভেষজ চামড়া বা নিরামিষ চামড়া তাও আবার হয় নাকি ?! যেন অনেকটা সোনার পাথর বাটির মতো শোনাচ্ছে । কিন্তু সত্যি সত্যিই এমনটি সম্ভব হয়েছে কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের চেষ্টা আর উন্নত প্রযুক্তির হাত ধরে।  প্রাণিজ চামড়ার বদলে এখন গাছ-গাছালির বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি হচ্ছে ভেগান চামড়া যা প্রাণীজ চামড়ার মতোই সুদৃশ্য ও টেকসই। বর্তমানে এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও ব্যবহার নিশ্চয়ই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর পথে আমাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে দেবে ।

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে আসছে জীবিত অথবা মৃত পশুকে । এমনকি পশুর হাড় ,মাংস ,চামড়া, শিং, নখ সমেত প্রায় সবকিছুই আমরা এখনো ব্যবহার করে আসছি সাড়ম্বরে। তার জন্য পশু হত্যাও হয়ে চলেছে নির্বিচারে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন পশু হত্যা করা হয় শুধুমাত্র চামড়ার যোগান দেবার জন্য । গরু, মোষ, শূকর এরা তো আছেই  সঙ্গে নানান বিপন্ন প্রাণী যেমন কুমির ,বাঘ, গন্ডার ,তিমি, শীল মাছ এদেরকেও মেরে ফেলা হচ্ছে সের্ফ চামড়া চাহিদা পূরণের জন্য । সেই চামড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যাগ ,জুতো ,জ্যাকেট, ঘর সাজানোর জিনিস আরো কত কি! শুধুমাত্র কিছু মানুষের স্টাইল স্টেটমেন্ট বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে প্রাণ যাচ্ছে বেচারা পশুদের।শুধু তাই নয় ,যারা পরিবেশ সচেতন তারা জানে কি পরিমান ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় চামড়া শিল্পে। ফলে মারাত্মকভাবে দূষিত হয় জলসম্পদ । এছাড়া কার্বন ফুটপ্রিন্টের পরিমাণও এক্ষেত্রে অনেক বেশি । 

এই বর্বরতা আর দূষণের মাত্রা কমাতে আগ্রহী কিছু মানুষ সহজ ও পরিবেশ বান্ধব সমাধান নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। বিভিন্ন উদ্ভিদের ফেলে দেওয়া অংশ থেকে শুরু হয় চামড়া নির্মানের কাজ। ধীরে ধীরে তার উপযোগিতা ও প্রয়োজন পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে। শুরু হয় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তার উন্নতি সাধনের চেষ্টা।

নিরামিষ চামড়া প্রথমবার সফলতার সাথে তৈরি হয় আপেলের খোসা থেকে ২০০৪ সালে ইতালিতে। এর পর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এর পরিধি। ছত্রাক থেকে প্রস্তুত চামড়া ” মাইলো ” কোম্পানি ব্যবহার করে জুতো প্রস্তুত করতে। ফ্রান্সে আঙুরের খোসা থেকে নির্মিত হলো  “ভিজিয়া” নামে ভেগান চামড়া। ফিলিপিন্স এ আনারসের খোসা থেকে নির্মিত হল”পিনাটেক্স”। 

টমেটোর খোসা, কলা গাছের ছাল, কর্ক, ফুলের পাপড়ি প্রায় বাদ গেলো না কিছুই। একে একে নতুন নতুন ভেষজ উপাদান চামড়া তৈরিতে ব্যবহার করতে শুরু করল নানা দেশের মানুষ। আসলে ভেষজ বর্জ্য বেশির ভাগ প্রায় একই প্রক্রিয়ায় চামড়ায় পরিণত করা যায়। প্রথমে তাকে পচিয়ে তার মধ্যে উৎপন্ন ফাঙ্গাসের সহায়তায় উন্নত প্রযুক্তি আর নিবিড় শ্রমের হাত ধরে তৈরি করা হয় এই নতুন ধরনের চামড়া। 

মরুভূমির একজাতীয় ক্যাকটাসের পাতা ব্যবহার করে দুই মেক্সিকান যুবক তৈরি করেছেন ” ডেজার্টো ” নামের এক অনবদ্য ভেষজ চামড়া। যা দিয়ে নির্মিত হয় সুদৃশ্য সব ব্যাগ, বেল্ট, জুতো।

 এই না হল সুস্থিত উন্নয়নের যুগ। নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি আর অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার  এক অভিনব উদ্যোগ। আর এসব তো এখন জেড প্রজন্মের হাতের মুঠোয়।

সদ্য বাজারে পা রাখা ভেগান চামড়ার বাজার মূল্য ও ভবিষ্যৎ দেখলে চোখ কপালে উঠবে যে কারও। ২০২৩ সালে উদ্ভিদ ভিত্তিক চামড়ার বাজার মূল্য যেখানে ছিলো ৭৩.৩৮ বিলিয়ন ইউ এস ডলার , আগামী ২০৩০ সালে তার আনুমানিক মূল্য দাঁড়াবে ১৩৯.০২ বিলিয়ন ডলারে। ভাবা যায়! ফ্যাশন দুনিয়ায় এই ধরনের চামড়ার ব্যবহার ও চাহিদা এখন তুঙ্গে। আনুমানিক ২০১৭ সাল থেকে নিষ্ঠুরতা মুক্ত ফ্যাশন এর যে নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে এ অনেকটা তারই ফলশ্রুতি । বিশ্বের তাবড় তাবড়  কোম্পানিগুলো তাই ভেষজ চামড়ার থেকে প্রস্তুত জামাকাপড় ও অ্যাক্সেসরিজ বাজারজাত করতে বেশ তৎপর। সুতরাং নতুন প্রজন্মের কাছে এ এক নতুন স্টার্ট আপ এর বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে।

বিশ্বে নতুন কিছু উদ্ভব হবে আর ভারত তার সঙ্গী হবে না এমনটা ভাবা ভুল। ভেগান লেদার প্রস্তুতিতে ভারতের মানুষও পিছিয়ে নেই। ২০০৬ সালেই হিমাচল প্রদেশে  নির্মিত হয় বিজয়ী নিপ্পন লেদারেট প্রাইভেট লিমিটেডে। যে নিপ্পন কোম্পানি র নাম আজ শেয়ার বাজার দখল করেছে। তবে প্রথমে তা ছিলো কৃত্রিম চামড়া বা পি ইউ লেদার বা পিভিসি এর মতো উপাদানে তৈরী। পরে তা ভেষজ উপাদান থেকেও নির্মিত হতে শুরু করে। কেরলে নারকেলের জল থেকে (ঠিকই পড়ছেন জল) নির্মিত “মালাই” লেদার বেশ জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। এছাড়াও আছে অলিভ ,ভর্টেক্স ফ্লেক্স, বায়ো লেদারের মত উঠতি কোম্পানি যারা ভেষজ চামড়া তৈরিতে ও সুস্থিত দ্রব্য উৎপাদনে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। 

তেমনই এক অভিনব চামড়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন কানপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র অঙ্কিত আগরওয়াল। তাঁর স্টার্টআপ কোম্পানির নাম “ফুল”,যা নির্মাণ করে ফ্লেদার অর্থাৎ ফুল নির্মিত লেদার। 

কানপুরের বিভিন্ন এলাকায় গঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া হত মন্দিরের ব্যবহৃত ফুল। যার পরিমাণ বছরে প্রায় আট মিলিয়ন টনের মত। ফলে প্রবল আকারে দূষিত হয় জলসম্পদ। সেই ফেলে দেওয়া ফুল সংগ্রহ করে তার থেকে জৈবিক পদ্ধতিতে ভেষজ চামড়া, ভেষজ সার বা ধূপকঠির মত নিত্যনতুন পণ্য নির্মাণ করে অঙ্কিতের কোম্পানি । এই কোম্পানির ৯৫ শতাংশ কর্মী মহিলা। এটি তো অনেকানেক কর্মকাণ্ডের একটি উদাহরণ মাত্র।

এভাবেই একদিকে যেমন ভেষজ বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার দূষণ কমাচ্ছে তেমনই পৃথিবীতে পশু হত্যার সংখ্যাও কমছে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে স্থানীয় কর্মসংস্থান। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের চামড়ার উৎপাদন ও তার বহুল ব্যবহারে প্রাণীজ চামড়ার জিনিসপত্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে আর আমরা পাবো দূষণ মুক্ত এক নির্মল সমাজ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top