মাউন্ট এভারেস্টের থেকেও বড় ধূমকেতু ?

12P/Pons-Brooks ধূমকেতুর ছবি | সৌজন্যে Aleix Roig এর এক্স হ্যান্ডল ।

ড. সায়ন বসুঃ কেমন লাগবে যদি কোন এক সন্ধ্যেবেলা আপনি বাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর হঠাৎ দেখলেন আকাশে প্রকাণ্ড আকারের মানে মাউন্ট এভারেস্টের থেকেও বড় এক ধূমকেতু ! জ্যোতিবিজ্ঞানীরা ঠিক এমনই এক ধূমকেতুর হদিশ পেয়েছেন যা কিনা খালি চোখে দেখা যেতে পারে| 12P/Pons-Brooks নামে ধূমকেতুটি ৭০ বছরে এই প্রথমবার আমাদের সৌরজগতে আসছে। যেহেতু এটি হ্যালির ধূমকেতুর মতন একটি ধূমকেতু তাই আমাদের জীবদ্দশায় হয়তো একবারই দেখা যাবে। সামনের ২১ এপ্রিল প্রথমবারের জন্যে এই ধূমকেতুটি সূর্যের সব থেকে কাছে আসবে। ধূমকেতুটি তারপরে পৃথিবীর আরও কাছে আসতে থাকবে এবং ২ জুন ২০২৪ এটি ২৩২ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে সবচেয়ে কাছে পৌঁছাবে।

যদিও এই তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে যে এই ধূমকেতুটি চতুর্দশ শতাব্দীতে দেখা গিয়েছিলো। এই নির্দিষ্ট ধূমকেতুটির দেখা মিলেছিল কমপক্ষে ১৩৮৫ সালের দিকে, যখন চীনা এবং ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটি দেখার রেকর্ড করেছিলেন। এই ধূমকেতুর নামকরণ করা হয়েছিল একজন ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিন-লুই পন্স (Jean-Louis Pons) নামানুসারে যিনি প্রথম ১৮১২ সালে আবিষ্কার করেছিলেন এবং একজন ব্রিটিশ-মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম রবার্ট  ব্রুকস (William Robert Brooks) নামানুসারে যিনি ১৮৮৩ সালে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

এই ধূমকেতুর কেন্দ্রে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (২০ মাইল) ব্যাসের একটি নিউক্লিয়াস আছে বলে মনে করা হচ্ছে| মনে রাখা ভালো যে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কিলোমিটারে মাপলে হবে ৮.৮৪৯ কিলোমিটার। সমস্ত ধূমকেতুর মতো, এটির পিছনে একটি লেজসহ একটি উজ্জ্বল কেন্দ্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। এটিকে একটি cryovolcanic ধূমকেতু হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, যার অর্থ এটি যখন গরম হতে থাকে (উদাহরণস্বরূপ এটি যখন সূর্যের কাছাকাছি চলে আসবে) তখন এর মধ্যে চাপ তৈরী হয় এবং বিস্ফোরণের সাথে ধূলিকণা, গ্যাস এবং বরফ বিচ্ছুরিত হয়। গত বছর এরকম একটি বিস্ফোরণ এটিকে একশতগুণ উজ্জ্বল করে তোলে এবং এটিকে ঘিরে থাকা ধোঁয়াশা একটি শিংযুক্ত আকৃতি তৈরি করে। এই আকৃতির জন্যে এটিকে “শয়তান ধূমকেতু” (Devil Comet) ডাক-নাম দেওয়া হয়। 

যদিও ধূমকেতু এবং এর সবুজ আভা – ইতিমধ্যেই রাতের আকাশে দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে আগামী সপ্তাহগুলিতে এটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ পল স্ট্রম বলেছেন, “ধূমকেতুটির উজ্জ্বলতা ৪.৫ মাত্রায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে যার অর্থ এটি গ্রেট ব্রিটেনের অন্ধকার অবস্থান থেকে দৃশ্যমান হওয়া উচিত।” “ধূমকেতুটি এন্ড্রোমিডা ছায়াপথ থেকে পাইসেস-এ (বাংলায় যাকে বলে মীন) চলে যাবে। এই সময় এটি বেশ কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে যাবে যা নির্দিষ্ট তারিখে এটিকে খালি চোখে চিহ্নিত করার কাজ সহজ করে তুলবে। বিশেষ করে, ৩১ মার্চ 12P/Pons-Brooks ধূমকেতুটি হামাল নামক উজ্জ্বল নক্ষত্র থেকে মাত্র ০.৫  ডিগ্রি দূরে হবে,” তিনি বলেছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডক্টর রবার্ট ম্যাসি বলেছেন, ধূমকেতুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও এটি খালি চোখে দেখতে এখনও কঠিন হতে পারে। তিনি মনে করছেন যে ছোট টেলিস্কোপের মতো মৌলিক যন্ত্রগুলি ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে এটিকে চিহ্নিত করতে। “যদি আপনার কাছে একটি সাধারণ মানের দূরবীন থাকে তবে অবশ্যই সেগুলির সাথে এটি সন্ধান করার চেষ্টা করুন,” ম্যাসি বলেছেন| সাথে আকাশের মানচিত্র তৈরি করে এমন অ্যাপগুলিও (যেমন Stellarium) এটিকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে।

বর্তমানে ধূমকেতুটিকে বর্তমানে উত্তর গোলার্ধের আকাশে সবথেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। যদিও জুন মাসে, এটি শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধে দৃশ্যমান হবে। ড. ম্যাসি বলেছেন যারা এক ঝলক দেখতে চান তাদের একটি পরিষ্কার সন্ধ্যায় বের হওয়া উচিত এবং গোধূলি শেষ হওয়ার সাথে সাথে পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিমে দিগন্তের দিকে দেখা উচিত। সাথে তিনি আরোও যোগ করেছেন, “আপনি কুয়াশা এড়াতে চান, আপনি চাঁদের আলো এড়াতে চান সাথে আপনি আলো দূষণ এড়াতে চান এই ধূমকেতুকে ভালো ভাবে দেখার জন্যে।” ড. স্ট্রম-এর মতে গ্রহাণুগুলির মতো, ধূমকেতুগুলিকেও প্রায়শই সৌরজগতের তৈরী হওয়ার জন্যে অব্যবহৃত বিল্ডিং ব্লক হিসাবে গণ্য করা হয়। 

আপনি যদি ৪ এপ্রিল পূর্ণ সূর্যগ্রহণের জন্য সামগ্রিকতার পথে থাকার ভাগ্যবান হন তবে আপনি সূর্য এবং বৃহস্পতির মাঝখানে এই ধূমকেতুটি দেখতে সক্ষম হবেন, যা সূর্যের উপরে এবং বাম দিকে প্রদর্শিত হবে। পূর্ণগ্রহণের চার মিনিট যখন চাঁদ সূর্যের সমস্ত আলোকে বাধা দেবে সেই সময় এই ধূমকেতুকে সব থেকে ভালো দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 12P/Pons-Brooks মহাকাশে ফিরে যাওয়ার পর, সূর্যের চারপাশে আরেকটি পূর্ণ বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে আরও ৭১ বছর সময় লাগবে। সেদিক থেকে দেখলে অনেকের কাছে এটিই শেষ সুযোগ এই ধূমকেতুকে দেখার| তবে যারা খুব অল্পবয়সী, তারা সম্ভবত ২০৯৫ সালের গ্রীষ্মে দ্বিতীয় সুযোগ পেতে পারে। জাপানের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি অফ জাপান (NAOJ) এর বিজ্ঞানী হিরোশি কিনোশিতা গণনা করেছেন যে ধূমকেতুটি ২০৯৫ সালের ১০ আগস্ট সূর্যের কাছে পৌঁছাবে।

12P/Pons-Brooks ধূমকেতু এবং এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের ছবি | সৌজন্যে Aleix Roig এর এক্স হ্যান্ডল ।

** লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top