মানভুমের লোকসংস্কৃতিতে নারীদের সম্মান 

ছবি: টুসু পরব (কাঁসাই নদীর পাড়ে, পুরুলিয়া )

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ সম্প্রতি আর জি কর কান্ড ও অন্যান্য কিছু ঘটনায় বাংলা তথা সমগ্র ভারতে নারীদের সম্মান, নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রশ্নের মুখে পড়েছে । কিন্তু মানভূমে স্মরণাতীত কাল থেকেই নারীদের প্রতি প্রভূত সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য দেখতে পাওয়া যায়। নারীদের প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের সম্মানের প্রতিফলন দেখা যায় এখানে প্রচলিত বিভিন্ন  প্রবাদ, ধাঁধা, ছড়া, লোকগান, লোককথা এবং বিভিন্ন পরব- পার্বণের রীতি- আচারে। যেমন নিম্নের কয়েকটি প্রবাদে মানভূমের মানুষের নারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রকাশ দেখা যায়: 

১ ) জমি লহে, জননী ।

স্বতন্ত্র প্রয়োগ : মাটি লহে, জননী ।

কৃষকদের জীবনে জমি মাতৃস্বরূপা। মা  যেমন সন্তানকে লালন-পালন করে, তেমনি জমি থেকে উৎপাদিত ফসলে কৃষকের পরিবার প্রতিপালিত হয়। তাই, এখানে জমিকে মায়ের সঙ্গে অভিন্ন বলে কল্পনা করা হয়েছে। মানভূম অঞ্চলে কৃষি কাজই মূল জীবিকা, তাই এখানকার কৃষকদের কাছে জমি প্রকৃতই জননীস্বরূপা। আলোচ্য প্রবাদটিতে একদিকে যেমন মায়ের প্রতি যেমন সন্তানের অপরিসীম শ্রদ্ধা , ভক্তির প্রকাশ দেখা যায়,‌ অন্যদিকে তেমনি  জমির প্রতি কৃষকদের নিগূঢ় শ্রদ্ধা-ভক্তির  পরিচয় পাওয়া যায়।

২ ) মাটি আর বিটি ,

যত সাজাবে ততই সাজবেক । 

স্বতন্ত্র প্রয়োগ : মাটি আর বিটি সাজালেই সাজে । 

আলোচ্য প্রবাদটিতে মাটি ও মেয়ের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়ার কথা প্রকাশিত হয়েছে।

মাটি ও বিটি (মেয়ে) উভয়েই সৃষ্টিশীলতার  ধারক। তাই , তাদেরকে যেরকম ভাবে ব্যবহার করা যায় , তারা সেরকম ভাবেই ফলবতী হয় ।

বিভিন্ন ফসল উৎপাদন পদ্ধতির প্রকৃতি অনুসারে মাটিকে বিভিন্ন রূপ দেওয়া হয়। ফসলের ভিন্নতা অনুযায়ী মাটিকে কখনো সমতল, কখনো ঢালু, কখনো ঢেউ খেলানো, কখনো শুকনো, কখনো কাদা, কখনো ঝুরঝুরে ইত্যাদি রূপ দেওয়া হয়। সুতরাং, কৃষকেরা মাটিকে বিভিন্নভাবে সাজাতে অর্থাৎ বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করতে পারেন এবং মাটির এই প্রকৃতি কৃষকের মনে সৃষ্টিশীলতার আনন্দ বজায় রাখে।

অনুরূপভাবে, মেয়েকেও বিভিন্নভাবে সাজিয়ে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায়। অলংকার, প্রসাধন সামগ্রী, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির মাধ্যমে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায়। মাটির মতো মেয়েকেও যতই সাজানো যাবে ততই তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

 এ সম্বন্ধে প্রচলিত লোকবিশ্বাস হল যে, মাটি এবং বিটি (মেয়ে)-কে উপযুক্ত যত্ন নিলে উভয়েই আশানুরূপ ফলবতী হয়। 

৩) যার আছে মাটি ,

তাখেই দিব বিটি ।

আগেকার দিনে মানভূম অঞ্চলের কৃষক- সমাজে কৃষিকাজ একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে গণ্য হতে। যার জমির পরিমাণ যত বেশি, সমাজে  তিনি তত বেশি সম্মান পেতেন।  স্বাভাবিকভাবেই, যার মাটি অর্থাৎ জোত-জমি বেশি আছে তার সঙ্গেই  প্রিয় মেয়ের  বিয়ে দিয়ে স্নেহশীল পিতা চিন্তা মুক্ত হতে চাইতেন। 

আলোচ্য প্রবাদটিতে কন্যার বাবা-মায়ের মানসিক অভিলাষটি জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে এবং এখানে প্রিয় কন্যার অন্য সংস্থানের দিকটি সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। কন্যার সুখ ও সচ্ছলতা পূর্ণ ভবিষ্যৎ জীবনের কামনা এই প্রবাদটিতে ফুটে উঠেছে।

এ বিষয়ে গ্রামবাংলায় প্রচলিত একটি প্রাসঙ্গিক ছড়ার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে- 

পুঁটু রানীর বিয়ে দেব

হপ্তমালার দেশে,

তারা গাই বলদে চষে

তারা দাঁতে সোনা ঘষে।

আলোচ্য ছড়াটিতে স্নেহশীল পিতা-মাতার প্রিয় কন্যা সন্তানের প্রতি অপরিসীম স্নেহ এবং কন্যার ভবিষ্যৎ জীবন যাতে সুখ, সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার  মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় সেই অবিলাষটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

৪) ক্ষেতের  ভিটা – মেয়্যালোকের সিঁথা ।

  (শব্দার্থ :  ভিটা -‘ভিটা’ বলতে এখানে ক্ষেতের  আইল কে বোঝানোহয়েছে। সিঁথা :  সিঁথি । )

ক্ষেতের আইল সংশ্লিষ্ট জমির সৌন্দর্যের বাহক। ক্ষেতের  চারদিকে ভালোভাবে আইল থাকলে তা জমির শ্রীবৃদ্ধি করে। অনুরূপভাবে মেয়েদের চুলের সিঁথি তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির সহায়ক। ভালো করে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ানো থাকলে তা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। বাঙালির একটি সামাজিক সংস্কার হল – নারীর কেশবিন্যাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নির্ভর করে তার সিঁথির বিন্যাসের উপর। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের মানুষদের সৌন্দর্য চেতনা ও নারীর প্রতি সম্মান প্রকাশিত হয়েছে আলোচ্য  প্রবাদটিতে।

অনেক সময় , শুধু ক্ষেতের জমি নয়,  কেয়ারিতেও (নার্সারি) সুন্দর আল নির্মাণ লক্ষ্য করা যায়। এও এসেছে সেই একই সংস্কার থেকে – 

নাকে সুন্দর ঝিয়ারি,

আলে সুন্দর কেয়ারি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মানভূমের প্রচলিত ভাদুগানেও নারীর প্রতি অপরিসীম সম্মান , আদর ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভাদু মানভূমের আদরের ধন , ভালোবাসার মানসকন্যা ‌। অধিকাংশ ভাদুগানে মা – মেয়ের মধুর সম্পর্কের অনাবিল ও সাবলীল প্রকাশ দেখা যায় । ‌ নিঃসন্তান রমণীর ভাদু পরব পালনের মধ্য দিয়ে সন্তান কামনার আশা থাকে –         

যদি কোলে আসে জাদু ,

আসছে বছর আনব ভাদু ।

এই কামনা অনেক সময় সফল হয়। কোল আলো করে আসে ভাদু ‌। বহু আদর- ভালোবাসায় তাকে লালন-পালন করা হয়-

ভাদুমণি মা গো,হলুদ বরণ গা গো ,   

সোনার খাট্যে হেলান দিবে,

রুপার খাট্যে পা গো ।

আবার মানভুমে প্রচলিত টুসু গানেও নারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , আদর ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখা যায়। আদরিনী উমার মতো টুসুও কখনো সাধারণ গরিব ঘরের কন্যা, কখনো বধূ , কখনো জননী। আদরিনী কন্যা রূপে টুসু – 

আমার টুসু অকুমারী,

আমরা কন্যা সাজাবো।

আনগো বিন্দে কাজল লতা ,

 নয়নে কাজল দিব।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মানভূমের বিভিন্ন লোকসাহিত্যে বহু প্রাচীন কাল থেকেই নারীদের প্রতি যথোচিত সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আদর, যত্ন ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর প্রকাশ দেখা যায়। বর্তমানের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’ প্রভৃতি প্রকল্পের বহু আগেই থেকেই মানভূমের লোকসংস্কৃতির জগৎ নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব অনেকটাই পালন করে চলেছে।

তথ্যসূত্র : 

১ ) লোকভূমি মানভূম : সম্পাদনা – শ্রমিক সেন,  কিরীটি মাহাত, বর্ণালী , ৭৩ মহাত্মা গান্ধী রোড কলকাতা ৭০০০০৯ , প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৫ ।

২ ) ভাদু (প্রবন্ধ ): সুশান্ত মাহাত, আগরডি পুরুলিয়া ।

৩ ) মানভূমের কৃষিসংস্কৃতি : ড . নিমাইকৃষ্ণ মাহাত,  নলেজ ব্যাঙ্ক পাবলিশার্স এন্ড ডিস্ট্রিবিউটরস , ৪১ বেনিয়াটোলা স্ট্রীট, কলকাতা- ৭০০০০৫ , প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ২০১৭ ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top