

ছবি – এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া
প্রীতি গুপ্তাঃ যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ শুধু মানুষকে নয়, প্রকৃতিকেও বিধ্বস্ত করে। পরিকাঠামো ধ্বংস, অস্ত্রের বিষাক্ত প্রভাব, বন উজাড় ও বন্যপ্রাণী নিধন—সব মিলিয়ে এটি পরিবেশের উপর ফেলে গভীর ছাপ, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সীমানা পেরিয়ে, জলবায়ু পর্যন্ত।
যুদ্ধের এই প্রভাব শুরু হয় অনেক আগে থেকে , যখন সামরিক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় নানা সম্পদ ব্যবহার হয়। বড় ধরনের সামরিক বাহিনী তৈরি ও বজায় রাখতে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার। এর মধ্যে রয়েছে ধাতু, মূল্যবান খনিজ, জল, তেল ও খনিজ সম্পদ।এছাড়াও সামরিক প্রস্তুতি বলতে বোঝায় ট্রেনিং, যা করতে গেলে প্রচুর জ্বালানি ও সম্পদ ব্যবহৃত হয়। সামরিক যান, বিমান ও জাহাজ চালাতে সব ক্ষেত্রে দরকার জ্বালানী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই শক্তি হয় বৈদ্যুতিক বা অপর্যাপ্ত জ্বালানী। বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র বাহিনীর কার্বন ডাইऑক্সাইড নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে—বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন গ্লোবাল গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৫.৫% এর জন্য দায়ী এই সেনা বাহিনী।
অতিরিক্ত, সামরিক কার্যক্রমের জন্য প্রচুর স্থল ও সমুদ্রের দরকার হয়। এই জায়গাগুলো প্রায়শই বাস্তুতন্ত্রের জন্য এবং জৈববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।সামরিক ট্রেনিং, অস্ত্রের ব্যবহার, বিমান ও যানবাহনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যাপক ক্ষতি সৃষ্টি করে, মাটিতে দূষণ, শব্দ ও রাসায়নিক বিকিরণের মাধ্যমে।
অবশ্যই, সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার সার্বিক দিক থেকে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। অনেক সময় অব্যবহৃত অস্ত্রের ডাম্পিং করে রাখা হয় বা আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অতীতের ইতিহাসে দেখা যায়, অপচয়রত অস্ত্র বা যুদ্ধঅস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রে ডাম্প করা হয়েছে, যা মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কারণ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে নতুন ধরনের ক্ষতিকর উপাদান যেমন PFAS বা নাইট্রোজেনযুক্ত বিষাক্ত উপকরণ সামরিক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অপ্রত্যক্ষভাবে, বৃহৎ সামরিক ব্যয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর । এই ব্যয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বহু ধরনের হতে পারে—কিছু সংঘর্ষ কিছুদিনের হলেও খুব ধ্বংসাত্মক হয়, আবার কিছু যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলেও কম প্রভাব ফেলে। তবে অধিকতর শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে পরিবেশের উপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে।যেমন, যুদ্ধের সময় জ্বালানীর চাহিদা ক্রমশ বাড়ে, ফলে CO2 নিঃসরণ বেড়ে যায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রথম তিন বছরে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন টিএক্স সমতুল্য CO2 নিঃসরণ হয়েছে, যা বহু দেশের মোট নির্গমনকেও ছাড়িয়ে যায়। এই ধরণের কার্বণ নিঃসরণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এক বড় কারণ।
আরেকটি ক্ষতির দিক হলো শত্রুপক্ষের আঘাতে পরিবেশে তৈরি হয় প্রচুর ধূলো, ধ্বংসাবশেষ যা বায়ু দূষণ বাড়ায়। এর পাশাপাশি, তেল বা খাদ্য উৎপাদন কেন্দ্র লক্ষ্য করে আঘাত হলে -অগ্নিসংযোগ, রাসায়নিক ক্ষয়, জল দূষণ ইত্যাদির মাধ্যমে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও ব্যাপক হয়। ইউক্রেনে চলমান সংঘর্ষের উদাহরণ দেখায়, কিভাবে পারমাণবিক অবকাঠামো সেখানকার বসতভিটা ধ্বংস করেছে— এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবেশ ও জনজীবন।
অস্ত্রের ব্যবহার যেমন ভূমি, জল ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর—বিশেষ করে ক্লাস্টার মিসাইল, ও অন্যান্য বিস্ফোরক জমির উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সৃষ্টি করে। অধিকাংশ যুদ্ধকালীন অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিষাক্ত উপাদান যেমন ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম এবং রাসায়নিক ক্ষারক। এই সব উপাদান ক্ষতিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী দূষণ সৃষ্টি করে।অন্যদিকে বিশেষ করে, ছোট অস্ত্র ও লাইট ট্রিগার অর্থাৎ পিস্তল, রাইফেল ব্যবহারে বণ্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। শিকার, চোরা শিকার ইত্যাদি বেড়ে যায়। যুদ্ধের কারণে পরিবেশে বিধ্বংসী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।যুদ্ধের পর ভূমিতে ফেলে যাওয়া বা বিস্ফোরিত মাইন, ক্লাস্টার বোমা, এবং অন্যান্য বিস্ফোরক পদার্থ মাটি ও জলে ধাতব ও বিষাক্ত উপাদান মিশিয়ে দেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধজাহাজ বা সাবমেরিন থেকেও সাগরে তেল ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক প্রচলিত অস্ত্রে থাকে রেডিওঅ্যাকটিভ ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম বা হোয়াইট ফসফরাসের মতো উপাদান, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বাস্তুচ্যুত জনগণ প্রায়ই জ্বালানির জন্য কাঠ বা কয়লার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যার ফলে বৃক্ষচ্ছেদন বেড়ে যায়। অপরাধী বা সশস্ত্র গোষ্ঠী বনজ সম্পদ, খনিজ ও তেলের অবাধ উত্তোলন শুরু করে। সোনার খনিতে পারদের ব্যবহার যেমন জলদূষণ ঘটায়, তেমনি তেল উত্তোলনের সময়ও সৃষ্টি হয় পরিবেশগত বিপর্যয়।যুদ্ধের কারণে অনেকে শহরে আশ্রয় নিলে সেখানেও জনসংখ্যার চাপ বাড়ে। পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে, জলের অভাব, বর্জ্য সমস্যা ও আবাসন সংকট তৈরি হয়। আবার বহু শরণার্থী আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশগুলোতে, যা সেইসব অঞ্চলের জন্যও পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনে।
সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতি শুধুমাত্র মানবিক সংকট নয়—এটি একটি পরিবেশগত জরুরি অবস্থা। অতীতে অনেক দেশ ও অঞ্চল যুদ্ধের ফলে পরিবেশগত দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণে দীর্ঘ সময় লেগেছে, অনেক সময় অপ্রত্যক্ষ ক্ষতি সব থেকে বেশি হয়।সেক্ষেত্রে আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মনোযোগ দেওয়া জরুরী। যুদ্ধ যেমন মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলে, তেমনি পরিবেশকেও মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলে। তাই সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবীর জন্য আমাদের যুদ্ধ বন্ধ করার পাশাপাশি পরিবেশের যাতে আর কোনও ভাবে ক্ষতি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
আরও পড়ুন
NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে
উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে
উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন
World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?
প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন
ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার
উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে। যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়। এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে। এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন