সম্পাদকীয়: যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং শূন্য সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে

কলকাতার পর এবার মহারাষ্ট্রের বদলাপুরে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।  সেখানকার একটি স্কুলে দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।  যদিও রাজ্য সরকার অবিলম্বে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছে,কিন্তু তারপরেও প্রশাসনের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে।  ঘটনাটি ঘটেছে আট-নয় দিন আগে।  মেয়েদের পরিবারের সদস্যরা যখন জানতে পারেন যে স্কুলের এক কর্মচারী তাদের মেয়েদের সাথে যৌন নিপীড়ন করেছে, তখন তারা পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করতে যায়।  কিন্ত অভিযোগ এই ঘটনাটি POCSO আইনের অধীনে মামলা হওয়া সত্ত্বেও, পুলিশ অভিযোগ দায়ের করতে বিলম্ব করে।  এতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে।

 কলকাতার ক্ষেত্রেও একই মনোভাব দেখা গেছে।  সেখানেও দেরিতে এফআইআর দায়ের করা হয়।  বেশ কিছু দিন ধরে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে।  এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই নারীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনের যথার্থতা ও প্রশাসনিক সতর্কতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।সম্প্রতি একটি বিস্ময়কর পরিসংখ্যান ন্যাশনাল সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স রিসোর্স সেন্টারের পক্ষ থেকে সামনে এসেছে । রিপোর্টে বলা হয়েছে  দেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন মহিলা এবং ৭১ জনের মধ্যে ১ জন পুরুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই এই কাজগুলির পরিণতি ধ্বংসাত্মক দিকে পরিচালিত হচ্ছে, যা মানসিক আঘাত, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ,এমনকি আত্মহত্যার চিন্তার দিকেও আমাদের যুব সমাজকে পরিচালিত করছে।

 ধর্ষণ, ভয় দেখিয়ে যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে, কিন্তু সেসব আইন গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়িত না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশের মনোভাব প্রায়ই ঢিলেঢোলা হতে দেখা যায়।  যৌন হয়রানির ঘটনা সমাজের নিম্নশ্রেণীর কোনো নারীর সঙ্গে সংগঠিত হলে পুলিশ অনেক সময় তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আবার অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব লাগিয়ে আইনের আওতা থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করে।  

 নির্ভয়ার ঘটনার পর নারীদের প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত কঠোর করা হয়েছে।  শিশু যৌন হয়রানি সংক্রান্ত POCSO আইনে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে এমনকি জামিন না দেওয়ারও বিধান রয়েছে।  কিন্তু এসব আইন যথাযথভাবে মানা না হওয়ায় এ ধরনের মামলা বন্ধ হচ্ছে না।  একথা অস্বীকার করা যায় না যে সমাজে যৌন বিকৃতি ও হিংসাত্মক প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে ইন্টারনেটে পরিবেশিত উস্কানিমূলক ও হিংসাত্মক উপাদানের একটি বড় অবদান রয়েছে।  তাই এ ধরনের কনটেন্ট অবলম্বে নিষিদ্ধ করা উচিত, সেইসাথে প্রশাসনিক শিথিলতা দূর করার ব্যাপারে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।

আমাদের দেশে যৌন হয়রানির অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই নীরবতা পালন করেন।  এমনকি যে ঘটনাগুলো পুলিশের কাছে পৌঁছায়, সেখানেও  অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের তৎপরতা দেখা যায় না।  তদন্ত এবং সাক্ষ্যগ্রহণ বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে।  অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের নামে পুলিশকে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে দেখা যায়।  যে কারণে হাই-প্রোফাইল মামলাও বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগে।  আজমীরে প্রায় বত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একই ধরনের যৌন হয়রানি মামলায় সম্প্রতি দোষীদের সাজা হয়েছে।  এরকম অনেক উদাহরণ আছে যেগুলোতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং সেগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, বিচারের জন্য ভুক্তভোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে,কিন্তু তারপরও প্রমানাভাবে অপরাধীরা থেকেছে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে।  এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ঠিক না হলে বিকৃত মানসিকতার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।তাই আজও শতাধিক নারীকে ভয় দেখিয়ে যৌন শোষণ করা হয়। তাই সময় এসেছে যৌন হয়রানি বন্ধ করার জন্য প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং শূন্য সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করতে একসাথে কাজ করার।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top