সম্পাদকীয় – বিতর্কে দারিদ্র্যের মাপকাঠি নিয়ে সরকারের যুক্তি

বর্তমানে দেশের দারিদ্র্যের মাপকাঠি নিয়ে সরকারের যুক্তি একটি বিতর্কের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারত গত কয়েক দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সরকার দাবি করছে যে দারিদ্র্যের হার ২০০৪-০৫ সালে ৩২.৭% থেকে ২০১১ -১২ সালে ২১.২% এবং ২০১৯ -২০ সালে আরও ৯.২%-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার রেকর্ড করা হয়েছে ৮.৪ শতাংশ।  নিঃসন্দেহে এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক পরিসংখ্যান।  এটি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি।  এভাবেই চলতি অর্থবছরের জিডিপি সব হিসাব ছাড়িয়ে যাচ্ছে।  রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার পুরনো অনুমান পরিবর্তন করে পুরো বছরের জন্য ৭.৭ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে।

উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে উৎপাদন খাতের ভালো কর্মক্ষমতা, কর আদায় বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি ব্যয় হ্রাস।এটি অবশ্যই পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তৈরির সরকারের ইচ্ছাকে আরও শক্তিশালী করবে।তবে এই পরিসংখ্যান অনেক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সংশয় সঙ্গে দেখা হচ্ছে. তারা যুক্তি দেখান যে দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য সরকারের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ এবং দেশে বঞ্চনার প্রকৃত মাত্রা সঠিকভাবে এতে ধরা পড়ছে না। কিন্তু এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার স্তরে স্তরে পরীক্ষা করলে অনেক অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতিও দেখা যাবে।উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সত্ত্বেও, আটটি প্রধান মৌলিক শিল্প – কয়লা, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, অপরিশোধিত তেল, শোধনাগার, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার এবং সিমেন্ট – মন্থর বৃদ্ধির হার রেকর্ড করেছে।

 এই সময়ে যখন বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন ভারতীয় অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে।  ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন, সেবা, টেলিযোগাযোগের মতো কিছু খাতে উন্নয়নের সম্ভাবনা বেশি বলে অনুমান করা হলেও এই সব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় তের শতাংশ কমেছে। কিন্তু সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও যদি এসব খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হয়, তাহলে তা অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।সমালোচকদের যুক্তি হল দারিদ্র্যের হার গণনার ক্ষেত্রে তথ্যে কারসাজি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে সরকার আর্থিক অগ্রগতি দেখাতে এবং রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য দারিদ্র্যের প্রকৃত মাত্রাকে কম করে দেখাচ্ছেন।

বিতর্কের আরেকটি ক্ষেত্র হল সরকারি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির কার্যকারিতা। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অ্যাক্ট (MGNREGA) এবং পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS) এর মতো দরিদ্রদের জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে সরকার অনেকগুলি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেও, অনেক সমালোচক যুক্তি দেন যে এই প্রোগ্রামগুলি দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। তারা দাবি করেন যে দরিদ্রদের জন্য নিদ্দিষ্ট অনেক সুবিধা কখনই তাদের প্রকৃত প্রাপকদের কাছে পৌঁছায় না, যা দারিদ্র্যের স্থায়ীত্বের দিকে পরিচালিত করে।অন্যদিকে সরকারের যুক্তি হল দারিদ্র্য হ্রাস এবং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এই যুক্তি থাকা সত্ত্বেও, ভারতে দারিদ্র্যের মাপকাঠিকে ঘিরে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।দেশের দারিদ্র্যের সমস্যাকে সত্যিকার অর্থে মোকাবেলা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শোনা এবং সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদাগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


মতুয়া আন্দোলনের এক মনোগ্রাহী ভাষ্য

অরবিন্দ পুরকাইত: আপাত বা গভীর কোনও স্তরেই তেমন কিছু তফাৎ পরিলক্ষিত না হলেও, বর্ণবাদী সমাজে একই পাড়ায় একেবারে প্রায় পাশাপাশি কেবল বিশেষ বিশেষ ঘরে জন্মানোর নিমিত্ত - শিক্ষাদীক্ষা পরের কথা – ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকেই আজীবন একজন শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রণাম পাওয়ার অদৃশ্য শংসাপত্রের অধিকারী আর অন্যজনের সেবা-শ্রদ্ধা-ভক্তির অদৃশ্য দাসখতের দায়বদ্ধতা! কেন-না সৃষ্টিলগ্নেই একজন প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখনিসৃত আর অন্যজন পদজ যে! সুতরাং মুখ থাকবে সবার উপরে, সবার নিচে পা – এতে অস্বাভাবিকতা বা আশ্চর্যের তো কিছু নেই! কিন্তু কেবল সেবা-শ্রদ্ধাতেই সব মিটে .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রয়াত "কালবেলা"-র স্রষ্টা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার

উত্তরাপথ: সাহিত্য একাডেমি পুরুষ্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার কলকাতার এক বেসরকারী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রামণের কারনে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম এই বিখ্যাত লেখকের।ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা (সাম্মানিক) স্নাতক বিভাগে৷ এর পর স্নাতকোত্তর  সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top