

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ ভারতসহ সারা বিশ্বে সুগন্ধি দ্রব্যের ইতিহাস স্মরণাতীত কাল থেকে প্রবাহমান। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা থেকে সিন্ধু সভ্যতা, বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ , সব কালে , সব দেশে সুগন্ধি দ্রব্যের চাহিদা ও ব্যবহার চিরন্তন। তবে তার ব্যবহারের রীতি নীতির বহু পরিবর্তন হয়েছে কালে কালে। সুগন্ধি বা পারফিউম এর মোহময় আবেশ যুগ যুগ ধরে মানুষকে বেঁধে রেখেছে এক অদ্ভুত ভালোলাগায়।
প্রাচীনকালে যা ছিলো রাজকীয় সম্ভোগের বিষয় আজ তা সর্ব স্তরের সব বয়সী মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। শুধুমাত্র পারফিউম হিসাবেই নয়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের ব্যবহার্য প্রতিটি জিনিস, সে টুথ পেস্ট হোক বা ধুপকাঠি , তেল হোক বা সাবান, বিয়ে বাড়ি হোক বা অফিস যাত্রা, বিশেষ বিশেষ গন্ধ আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের একটিকে, বিশেষ ভাবে পরিতৃপ্তি দিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে । প্রাচীন মিশরে একে তুলনা করা হয়েছে ঈশ্বরের ঘামের সঙ্গে।
আমরা আজ কথা বলব সেই সুগন্ধি দ্রব্যের উপাদান নিয়ে। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে কালেয়ক, অগুরু, চন্দন, কস্তুরী,কুমকুম, মন:শিলা, মঞ্জিষ্ঠা ,চাঁপা ইত্যাদি উপাদান সিদ্ধ করে বা তেলে মিশিয়ে সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহার করার উল্লেখ পাওয়া যায়। পারস্য, ইরান, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে পরবর্তি কালে বিভিন্ন ফুলের নির্যাসে প্রস্তুত আতরের মত সুগন্ধি দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছে। বিদেশী পারফিউম এর মধ্যে ফ্রেঞ্চ পারফিউম অসাধারণ হলেও তা সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন দেশীয় কোম্পানি গুলো এগিয়ে এলেও সস্তা আলকোহল বা ইথানলের ব্যবহার নানা সমস্যার সৃষ্টি করছিল। মাঝখানে সাধারণ মানুষ তাই আস্থা হারাচ্ছিলো সুগন্ধি দ্রব্যের নিত্য ব্যবহারে। এই সময় জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার বিচারে পারফিউমের সৌরভ প্রায় বিলীন হতে বসেছিল।
ইতিমধ্যে মুক্ত অর্থনীতি আর টেকনোলজির হাত ধরে সারা বিশ্বের ফ্যাশন জগতে এলো বিপুল পরিবর্তন। ফাস্ট ফ্যাশন এর অঙ্গ হয়ে উঠলো ফাস্ট চেঞ্জিং পারফিউম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা ছোট বেলায় যদিওবা বাবা মায়ের অনুমতিক্রমে অনুষ্ঠান বাড়িতে একটু আধটু সেন্ট এর ছিটে পেতাম এখনকার জেন জি তো এবেলা ওবেলা পারফিউম পাল্টায়। যুগের সাথে তাল মেলাতে তাই বদলে গেলো সুগন্ধি উপাদান গুলোও। সাইক্লোমেথিকোন নামক রাসায়নিক এর ব্যবহার এযুগে পারফিউম কে করে তুলেছে অনেক বেশি স্কিন ফ্রেন্ডলি।
বিশ্বে নতুনত্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ভারত কখনও পিছপা হয়না। সে আমরা মানি বা নাই মানি। বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানিকে টক্কর দিয়ে বেঙ্গালুরুর মত বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে বিশ্বমানের ভারতীয় পারফিউম কোম্পানি। সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়লো কাঁচা মালের বা প্রাকৃতিক সুগন্ধি নির্যাসের। ভারতের বিজ্ঞানীরাও এই নতুন সুযোগের হাতছানিতে সারা দিয়ে সূচনা করলেন ‘সুগন্ধি মিশন’ বা Auroma Mission এর । ভারতে সরকারি প্রকল্পের আওতায় CSIR এর উদ্যোগে শুরু হয় এই নতুন মিশনের, যা ভারতে সুগন্ধী দ্রব্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ৬০০০০ হেক্টর জমিতে ৪৬ টি জেলায় প্রশিক্ষিত কৃষকদের দিয়ে চাষ করা হয় সুগন্ধী লাভেন্ডারের। কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ সহ উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, দাক্ষিণাত্যের পার্বত্য অঞ্চলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ল্যাভেন্ডার এর চাষ। কাশ্মীরে এর অঙ্গ হিসাবে ছড়িয়ে পড়েছে, ‘বেগুনি বিপ্লব’ অর্থাৎ ব্যাপক হারে ল্যাভেন্ডার চাষ। গোটা উপত্যকা জুড়ে বেগুনি রঙের সমাহার। মূল্যবান ল্যাভেন্ডার অয়েল বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছে প্রান্তিক চাষিরা। মজবুত হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এছাড়াও এর অঙ্গ হিসাবে কম বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে লেমন গ্রাস, মেন্থল প্রভৃতি ঔষধি গুণ সম্পন্ন সুগন্ধি উদ্ভিদ চাষ করা হয়েছে। যা থেকে প্রাপ্ত তেল রপ্তানি করে আয় বেড়েছে গ্রামীণ চাষিদের। এযাবৎ সুগন্ধি মিশনের তিনটি পর্যায় সমাপ্ত হয়েছে এবং ফলও আশানুরূপ। শুধু তাই নয়, ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিজ ফসলের উৎপাদনের নিশ্চয়তা হ্রাস পাওয়ায় এই মিশনের আওতায় বিকল্প চাষের সন্ধান পেয়েছেন বহু মানুষ। এই নিবিড় কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন বহু মহিলাও। খুলেছে আয়ের উৎস। নতুন প্রজন্মের জন্য নিয়ে এসেছে নতুন স্টার্ট আপ এর সুযোগও।
সুগন্ধির এই নতুন দিগন্ত ভারতের অর্থনীতিকে এভাবেই আরও সুবাসিত করবে এই আশা রাখি।
আরও পড়ুন
Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে
উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন
সম্পাদকীয়- রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র
সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন
ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে
উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন
Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক
উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন। ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন