

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে ওজোন স্তরে ছিদ্র বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে ছবি- উত্তরাপথ
উত্তরাপথঃ কৃত্রিম উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে ওজোন স্তরে ছিদ্র বেড়ে এবছর মহাদেশটির প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গবেষকদের মতে, গত বছর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এমন হতে পারে। আসলেই কি তাই? ওজোন স্তরের ছিদ্র আসলে কত বড়?
ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলেরই অংশ। ভূপৃষ্ঠের ১৫ কিলোমিটার ওপর থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এ স্তরের বিস্তৃতি। একে ওজোন স্তর বলার কারণ, এখানে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব অনেক বেশি। অক্সিজেনের অণুতে দুটির পরিবর্তে তিনটি অণু থাকলে সেটাকে বলা হয় ওজোন গ্যাস। এর রাসায়নিক সংকেত (O3)। সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকে দেয় ওজোন স্তর। তাই মানুষসহ পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকার জন্য ওজোন স্তর খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের ওজোন স্তরে বড় ধরনের ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীতে তখন সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের (CCl2F2) ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অ্যারোসল ক্যান, ফ্রিজ বা পণ্য প্যাকেটজাত করার মতো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল এ রাসায়নিক। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন সহজে কোনো গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। তবে সূর্যের আলোয় এর অণু ভেঙে ক্লোরিন আলাদা হয়ে যায়। মুক্ত ক্লোরিন ওজোন গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়ায় ক্লোরিন মনোঅক্সাইড (ClO) ও অক্সিজেন অণু (O2) তৈরি করে। অর্থাৎ ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল ওজোন স্তর। ফলে ১৯৮৯ সালে ওজোন স্তরের ক্ষতি সারিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতারা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
তবে, এখনও উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকালে মেরু অঞ্চলের ওপরে ওজোন স্তরে ক্ষত তৈরি হয়। কারণ, শীতকালে ঠান্ডা বাতাস পোলার স্ট্র্যাটোস্ফেরিক ক্লাউড বা পিএসসি নামের বিশেষ ধরনের মেঘ তৈরি করে। এই মেঘের অনেক ছোট ছোট বরফকণা ওজোন গ্যাসের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে যায়। পাতলা ওজোন স্তর তখন আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ বছর অ্যান্টার্কটিকার ওপরে ওজোন স্তরের সবচেয়ে বড় ছিদ্রটি ধরা পড়ে ১৬ সেপ্টেম্বর। কোপার্নিকাস সেন্টিনেল-ফাইভপি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওজোন স্তরের ক্ষতির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ESA’র তথ্যমতে, ছিদ্রের আয়তন প্রায় আড়াই কোটি বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ আয়তনে প্রায় উত্তর আমেরিকার সমান। অন্যভাবে বললে, ব্রাজিলের তিনগুণ অথবা রাশিয়া-চীনের সমান আয়তনজুড়ে ছিদ্র তৈরি হয়েছে ওজোন স্তরে।
এ বছর নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই ওজোন স্তরে ছিদ্র তৈরি হয়েছে। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে দ্রুত বেড়েছে এই ছিদ্রের পরিমাণ ।ছিদ্র এত বড় হওয়ার পেছনে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত হাঙ্গা টোঙ্গা-হাঙ্গা হাপাই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে অনেকটাই দায়ী মনে করা হচ্ছে। হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে ১০০ গুণ শক্তিশালী ছিল এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। ফলে তৈরি হয় সর্বকালের সবচেয়ে উঁচু বিস্ফোরণস্তম্ভ।
অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ওজোন স্তর অস্থিতিশীল হতে পারে বলে গত বছর আগস্টেই বিজ্ঞানীদের কয়েকটি দল আলাদাভাবে সর্তক করেন। কারণ ওই ঘটনার কারণে প্রায় ৫ কোটি টনেরও বেশি জল ছড়িয়ে পড়ে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে। গোটা বায়ুমণ্ডলের জলীয় কণার পরিমাণ বেড়ে যায় প্রায় ১০ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ওজোন স্তরে গিয়ে ভেঙে আয়ন বা চার্জিত অণুতে রূপ নিতে পারে। ফলে সিএফসির মতো ওজোন গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সম্পূর্ণ ওজোন স্তরকে করে তুলতে পারে অস্থিতিশীল। শুধু তাই নয়, ESA’র মতে, জলীয় বাষ্প বেড়ে যাওয়ার কারণে মেরু অঞ্চলে পিএসসি বা পোলার স্ট্র্যাটোস্ফেরিক ক্লাউড তৈরির হার বেড়ে যেতে পারে।
প্রাকৃতিকভাবে দুই মেরুর ওজোন স্তরের পরিবর্তনও এ বছরের বৃহত্তম এই ছিদ্র তৈরির পেছনে দায়ী হতে পারে। ২০১৯ সাল অ্যান্টার্কটিকার ওজোন স্তরের ছিদ্র এত দিনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হয়ে এসেছিল। কারণ বায়ুমণ্ডলের অস্বাভাবিক উষ্ণ তাপমাত্রার জন্য পিএসসি তৈরি হয়নি তখন। কিন্তু ২০২০ থেকে ২০২২ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কিছুটা কমে গিয়েছে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতি বছর বাড়ছে ওজোন স্তরের ছিদ্র।
এ বছর এল নিনোর প্রভাব মেরুর চারপাশের তাপমাত্রা পরিবর্তনে সামান্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ দুইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ESA’র গবেষকেরা বলছেন, ওজোন স্তরের ছিদ্র বড় হলেও এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। কারণ ছিদ্রের নিচের এলাকা প্রায় জনবসতিহীন। তা ছাড়া কয়েকমাসের মধ্যেই এ ছিদ্রের আয়তন কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। সিএফসি ব্যবহারের পরিমাণ যদি এখনকার মতোই কম রাখা যায়, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে ওজোন স্তর নিজেকে পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তাঁরা।
সূত্র: Live Science and Space.com
আরও পড়ুন
Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি। ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে। আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি। এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে। এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন
ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে
উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন
ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার
উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে। যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়। এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে। এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন