

অসীম পাঠকঃ মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালের একশো একচল্লিশ নম্বর বেডে শুয়ে আকাশের দৃষ্টি শরতের নীল আকাশে থমকে। পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ, গিনি সোনার মত রোদ ছড়িয়ে পড়ছে দিক থেকে দিগন্তে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি। জানালার পাশ থেকে পুরো আকাশটা দেখা যায়না, তবুও যেটুকু চোখে পড়ে ঝাঁ চকচকে অভিজাত ফিল্ম সিটির এই স্বপ্নের শহরে সে আজ সুন্দর পৃথিবীর অসুস্থ ঠিকানায় বন্দী। তার মানসপটে ভেসে ওঠে অতিক্রান্ত সময়ের ছবি।
প্রত্যন্ত গ্রামের বনেদী বাড়ির ছেলে আকাশ , স্বপ্ন ছিলো বাবার মতো সেও অধ্যাপক হবে আর লিখবে সমাজের পরিবর্তনের কথা। একজন সাকসেসফুল রাইটার হবে। একদিন হয়তো তার লেখা গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র হবে। দুনিয়া জোড়া নাম হবে । কিন্তু বিধি বুঝি বাম। বিশ্ব বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে বি এড ট্রেনিং শেষ করে কোলকাতার একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যখন সে নিজেকে তৈরী করছে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্য , তখনই প্রায় অসুস্থ বোধ করতে লাগলো। মাসখানেক পাত্তা না দিয়ে মেডিসিন শপ থেকে এটা ওটা ওষুধ কিনে খেতে লাগলো , তারপর একদিন পূজোর ছুটিতে গ্রামে এসেই অসুস্থ বোধ করতেই জেলা হাসপাতালে ভর্তি করলেন তার বাবা অনাদি বাবু। ধরা পড়লো লিভার ক্যানসার। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখী সচ্ছল পরিবারে নেমে এলো অমানিশার কালো মেঘের ছায়া।
শুরু হলো মুম্বাইয়ে চিকিৎসা। কেমোর কঠিন যন্ত্রণা চূল শূন্য মাথায় এখনো কবিতা আসে আকাশের। এখনো সে লেখে হৃদয়ের বোবা আর্তনাদের কথা। বারাবরই সে লেখে দারুণ। গোটা বাড়ি জুড়ে আকাশের পুরস্কার আর প্রশংসাপত্রের ছড়াছড়ি। অজস্র ট্রফি। সাহিত্যের ছাত্র সে, একবুক স্বপ্ন নিয়ে জীবনের দিনলিপি লিখতো সে। হঠাৎই ছন্দপতন। তবুও অজস্র শব্দের পোকা কিলবিল করে তার মাথায়। বোন পায়েল দাদা অন্ত প্রান। দারুণ বন্ডিং ভাই বোনের। মা মাধবী দেবী বলতেন এই দুটো থাকলে গোটা বাড়িতে আর কারো কথার কোন দাম নেই। যেকোন উৎসবে পূজোতে মেলাতে ভাই বোন দাপিয়ে বেড়াতো।বর্ষার টগর শরতের কাশ ফুল আর বসন্তের পলাশে আকাশের মন জুড়ে থাকতো শুধু একটি ই নাম সুহানা। শীতের পিঠেপুলিতে ছাদ বাগানের গাঁদা চন্দ্র মল্লিকায় সুহানা নামের মিষ্টি বাতাসটা খেলে যেতো।
নার্সারি থেকে হায়ার সেকেন্ডারী বারো বছরের অনাবিল বন্ধুত্বে প্রেমে আকাশ আর সুহানা যেনো এক বৃন্তে দুটি ফুল । কতো ঝগড়া কতো গল্প কতো মান অভিমান সব কিছুর নীরব সাক্ষী মাথার উপরে উদার নীলাকাশ আর সবুজ মাটি। মাধবী দেবী সব জানতেন আর জেনেও প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কারন সুহানা নামের মিষ্টি ফুলটা যে তাঁর হৃদয়েও ভালোবাসার ঝর্না বইয়েছিলো। অনাদি বাবু তো সাংসারিক জগতের বাইরে থাকা একজন মানুষ। দূর থেকে মনে হবে নীরস পদার্থ বিজ্ঞানের নির্লিপ্ত সাধক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দারুণ রোমান্টিক, অনেকটা শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন।সুহানা হায়ার সেকেন্ডারীর পর জয়েন্ট এন্ট্রান্স এ কোয়ালিফাই করে ডাক্তারি পড়তে প্রানের শহর বর্ধমান ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যায় পাঁচ বছরের জন্য। দুজনের লক্ষ্য আলাদা । একজন সাহিত্য নিয়ে এগুবে আর একজন চিকিৎসক হবে।
এদিকে সাথী হারা আকাশ বর্ধমানের মাটিতে অপেক্ষায় থাকে তার মনের মানসীর। সে ভাবে প্রতিটা প্রেমের গল্পই তো অসমাপ্ত, তাই তার সব লেখা নিঃশব্দে সমর্পন করে সুহানাকেই। মাঝে মাঝে একটা চিন্তা যেনো গ্রাস করে তাকে , আচ্ছা তাদের পরিবার না হয় অস্বীকার করবে না , কিন্তু সুহানার বাবা কি মেনে নেবেন বিধর্মী আকাশ কে জামাই বলে। সুহানা খান বর্ধমানের নাম করা ক্রিমিনাল ল ইয়ার জাভেদ খানের একমাত্র আদরের দুলালী। বিদায় বেলায় সুহানা সেই ভিড় প্লাটফর্মে আকাশের হাতে হাত রেখে বলেছিলো , তুই এমন করছিস যেনো আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। এই চল না একটু কফি খাই। দুজন যেনো দুজনের মন পড়ছে । কেও কাওকে ব্যাথা দিতে চায়না। আকাশ সানগ্লাসে ভেজা চোখ আটকে বলেছিলো , আরে পাগলী আমি তো ভাবছি এই তিনবছরে পার্ট টাইম একটা জোগাড় করি কাওকে। এতো সুন্দর কলেজ লাইফটা কি নিরামিষ থাকবো ? সুহানা বলেছিলো , এই খবরদার , যদি তোর ধারে কাছেও কাওকে আসতে দেখি খুন করে ফেলবো। আকাশ বলে , তুই টেরই পাবিনা। মুখ ভেংচে সুহানা বলে তোকে আমি জ্যান্ত কবর দেবো , যদি শুনি কিছু গড়বড় করছিস তাহলে …. কথা শেষ হয়না দুজনের মাঝে পায়েল এসে দাঁড়ায় , এই দাদা এই বৌদি তোমরা কি শুধু ঝগড়াই করবে গো ? তার চেয়ে রোমান্টিক মুডে দাঁড়াও একটা সেলফি নিই, বলা যায়না যদি বিয়ের পর এই একমাত্র ননদকে পর করে দাও, এখন থেকেই নিয়ে রাখি বাপু। আকাশ পায়েলের চুলে একটা টান মেরে বলে , এই শাঁখচুন্নী একদম বলবি না এসব। সুহানা বলে আমার এই মিষ্টি বোনটা আমি খুব মিস করবো। আকাশ বলে হ্যাঁ ওই পেত্নী আর শাঁখচুন্নী দুজনে তো খুব ভাব। আর কথা এগোয়না। দানবীয় গর্জনে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এসে পড়ে। গোটা প্লাটফর্ম জুড়ে কোলাহল ময় ব্যাস্ততার মাঝেও এক নৈশ নৈশঃব্দে ছেয়ে যায় আকাশের মন। সুহানাকে নিয়ে আকাশের বিরাট স্বপ্ন জাল , তার কল্পনার মশলায় গড়া ইমারতে সব কবিতা গল্প যেনো এক নির্মল প্রেমের স্মৃতি সৌধ। আকাশের ল্যপটপে পাস ওয়ার্ড টা অবধি সুহানা নামে সংরক্ষিত। আর প্লাটফর্মে কফি খেতে খেতে নেওয়া সেলফিটা সুহানার মোবাইলে ওয়ালপেপার থেকে ফেসবুক প্রোফাইল সর্বত্র বিরাজমান।
কে বলে আধুনিক প্রজন্ম ডিজিটাল , এরা প্রেম ভালোবাসা বোঝেনা ক্যারিয়ার বোঝে । অন্তত আকাশ আর সুহানা দুজনকে দেখে মনে হয় এরা প্রান উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। স্কুল থেকে ফেরার পথে লাল মাটির রাস্তায় রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুজনে গাইতো , “সারাদিন রিমঝিম ঝিম কতো বৃষ্টি কতো বৃষ্টি হয়েছে মন জুড়ে “। ফুচকার স্টলে দুজনের কম্পিটিশন চলতে কে ফার্স্ট হবে, ব্যাডমিন্টনেও তাই। আকাশ কিন্তু মুখে জোর দেখাতো খুব আর চাইতো সব প্রতিযোগিতায় সুহানাকে জিতিয়ে দিতো। সেই যে একবার ছোটবেলায় লুডো খেলায় সুহানা হেরে গিয়ে খুব কেঁদেছিলো, তখন থেকেই আকাশ নিজে হারতো আর কপট রাগ দেখাতো। সুহানা সব বুঝেও খুশী দেখতে চাইতো আকাশের মুখে। অপার্থিব ভালোবাসার স্বর্গরাজ্যে দুজন যেনো দুজনের পরিপূরক।
হঠাৎই আকাশের ভাবনায় ছেদ পড়ে , লেডি ডক্টর আকাশের প্রেশার পালস রেট চেক করার জন্য তার বেডের সামনে দাঁড়ায়। আকাশ হঠাৎ যেনো চমকে ওঠে বলে তুমি? , ভুল দেখছে না তো। সুহানা কি ? না না তা কি করে সম্ভব … এ তো ডক্টর অনিতা বর্মন। পরক্ষনেই সরি বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ডক্টর অনিতা বলেন , হেলো মিঃ আকাশ হাউ আর ইউ। আকাশ বলে একজন মৃত্যু পথযাত্রী আর কেমন থাকবে ডক্টর। ডক্টর অনিতা বলেন , আপনি মনে জোর রাখুন , এটাই সবচেয়ে বড়ো মেডিসিন ক্যানসারকে হার মানানোর। আকাশ বলে আমি তো একটা জিন্দা লাশ। মরে গেছি অনেক আগেই।
এই দীর্ঘ চিকিৎসার কিছু সময়ে ডক্টর অনিতার সাথে আকাশের পেশেন্ট ডক্টর বাদ দিয়েও এক নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়েছে। ডক্টর অনিতা সব দেখে রিপোর্ট নোট করে বলেন , ঘাবড়াবেন না মিস্টার আকাশ। আমি রুটিন ভিজিট কমপ্লিট করে আসছি। লনে বসে কফি খাবো একসাথে। একটুতেই আকাশ এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হসপিটাল স্টাফদের সহায়তায় মাঝে মাঝে লনে গিয়ে বসে আবার বেডে বসেও কিছু লেখা মাথায় এলেই বোন পায়েলকে ফোন লাগিয়ে বলে , লিখতো আমি বলি, আর কটা দিন বিরক্ত করি তোকে। পায়েল প্রচ্ছন্ন ধমকের সুরে বলে , দাদা থামবি , তারপর চোখের জল মুছে বলে , হ্যাঁ বল । আকাশ বলে যায় বিরহ ব্যাথাতুর জীবনে আঘাত জর্জরিত শব্দ মালায় সাজানো তার অনুভুতির কথা। উপলব্ধির নির্যাসে হেমলকের জ্বালা যন্ত্রণাময় অস্তিত্বের কথা। রোগে শরীর অচল, আর মন সেও যেনো নির্বাসিত একাকী জনমানবহীন পরিত্যক্ত এক দ্বীপে।জীবন উপন্যাসের ক্লান্তিকর অধ্যায় জুড়ে সুহানার স্বপ্ন কে সফল করার এক করুন প্রয়াস চালিয়ে যায় আকাশ। যেনো অসম যুদ্ধে সে বিধ্বস্ত ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত। তবুও লিখতে হবে ধূসর জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা। সুহানার শেষ স্বপ্ন তাকে সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার পেতেই হবে।
লনে বসে ডক্টর অনিতা আকাশকে বলে , আচ্ছা মিস্টার এই যে এতো লিখেছো বা এখনও লিখে চলো তুমি এটার মধ্যেই প্রেরনা দাও সমাজ সভ্যতাকে। আচ্ছা তুমি কি জানো , যে তোমার গ্যালারি উপন্যাস টা আমার হাজব্যান্ডের খুব পছন্দ। আকাশ বলে , তাই ? সে জানে অনিতার স্বামী একজন ফিল্ম প্রোডিউসার। অনকোলজিস্ট স্ত্রীর প্রোডিউসার স্বামী , এ নিয়ে আকাশ একটা মজার কবিতা লিখে দিয়েছিলো। অনিতার স্বামী আদিত্য খুব হেসেছিলো কবিতা পড়ে। শব্দহীন মন্থরতা ভেদ করে শান্ত গলায় আকাশ বলে , ফোনের গ্যালারি হয়তো একদিন নিশ্চিহ্ন হবে কিন্তু মনের গ্যালারি মরলেও পুড়ে ছাই হবে না। অনিতা বলে , হুম বুঝছি, তা এই যে আমার মতো সুন্দরী স্মার্ট ডক্টরের সামনে আপনি বসে আছেন , আপনার কি কোন ফিলিংস আসছে না ? নাকি সুহানাতেই ডুবে। আকাশ বলে জানেন ডক্টর অনিতা , যেদিন সুহানাকে শেষবার দেখেছিলাম ওর লাস্ট ইয়ারে , আমি তখন মা কে চেকআপ এ ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গিমেছিলাম। সাতটা দিন একসাথে কেটেছিলো স্বপ্নের মতো। শপিং মলে শেষ সেলফি নিয়েছিলাম। মা তো তার আদরের হবু বৌমাকে ওখানে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিলো , তো সুহানা বললো এটা পরেই সেলফি নেবো। সে ছবিটাই আমার গ্যালারি উপন্যাসের প্রচ্ছদ। অনিতা বলে দেখেছি, কি মিষ্টি দেখতে ছিলো সুহানা। আকাশ যেনো এ কথায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বলে ছিলো নয়, আছে, আছে ডক্টর। এখনো সুহানা আসে আমি যখন কেমোয় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকি , তখন সে চুপিচুপি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যায়। অনিতা বলে, চলুন আপনাকে বেডে পৌঁছে দিই।
বেডে শুয়ে অসুস্থ আকাশের চোখ জলে ভরে আসে। সুহানার চলে যাওয়া টাও আজ তিন বছর হয়ে গেলো। পড়া শেষ করে ওখানেই একটা বেসরকারি নার্সিং হোমে সে ঢুকেছিলো। সবাই আপত্তি করেছিলো, যে চলে আয় এখানে। কথা শোনেনি মেয়ে। আকাশকে ফোনে বলতো অনেক অনেক টাকা জমাতে হবে রে , দুজনে পুরো পৃথিবী ঘুরবো। কত নতুন দেশ যাবো। আকাশ মজা করে বলতো, বলতো হ্যাঁ আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেওনা খবরদার। শুনে সুহানা বলতো, এই তুই যখন বুড়ো হবি তখন কি তোর মাথা ভর্তি টাক হবে ? আকাশ বলতো, আর তুই ফোকলা বুড়ি। সুহানা হেসে বলতো, তখনও আমরা সিঙ্গাপুরে ঘুরবো। স্বপ্নের শহর ইতালির ভেনিস ঘুরবো। যেদিন শেষবার কথা হলো সুহানার সাথে ভিডিও কলে সেদিন প্রথমেই ফ্লাইং কিস দিয়ে সুহানা বলেছিলো, এই হাঁদারাম তুই তো বেশ স্বার্থপর, নিতে জানিস, দিতে জানিসনা। সেদিন যেনো সুহানা আরও ডেসপারেট হয়ে উঠেছিলো।
ফোন যেনো ছাড়তেই চায়না। সুহানার মধ্যে কেমন যেনো একটা প্রানখোলা বন্যতা ছিলো। একবার কল করে না পেলে চারদিকে গোটাফ্রেন্ডস সার্কেল অতিষ্ঠ করে তুলতো। পায়েল কে ফোন মাকে ফোন মানে সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। সুহানা ছোট বেলাতেই মাকে হারিয়েছিলো। তাই আকাশের মাকে সে মা বলেই ডাকতো। শেষদিকটাতে সুহানার বাবাও একপ্রকার ধরেই নিয়েছিলেন যে আকাশ ই তাঁর হবু জামাই।
শেষবারের কলটা ছিলো রাত দশটা দশে। আর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ভোর সাড়ে পাঁচটায় আকাশদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জাভেদ খানের কালো স্করপিও গাড়িটা। আকাশকে পায়েল ঘুম থেকে তুলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিছুই বলতে পারে না। শুধু আকাশের বাবা বলেন, রেডি হয়ে নে তোর জাভেদ আংকলের সাথে এক্ষুনি ব্যাঙ্গালোর বেরুতে হবে। এগারটায় ফ্লাইট তার আগে দমদম পৌছাতে হবে। আকাশের মুখে কথা বেরোয়না, সে বাড়ি এসেছিলো বড় দিনের ছুটি কাটাতে আর বড়োদিনের রাতেই কি এমন তোলপাড় করা ঘটনা ঘটে গেলো? জাভেদ খান মর্মাহত হয়ে সোফাতে বসে। আকাশকে দুঃসংবাদ টা তিনি ই দেন। বলেন বাবা হয়ে আমি যদি পারি, তোমাকেও পারতে হবে আকাশ, চলো। আকাশ তখনও ভ্যাবাচ্যাকা। জাভেদ খান বলেন, সুহানা এ পৃথিবীতে আর নেই। আকাশ যেনো ইলেকট্রিক শক খেয়ে যায়, বলে কি বলছেন ? তক্ষুনি আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় । ভেতরে ঢোখেন স্থানীয় থানার অফিসার ইন চার্জ অবিনশ শাসমল। ভনিতা না করেই বলেন এই যে সবাই এখানে, আসলে অধ্যাপক সাহেব আমি ই উকিল বাবুকে কাল রাত আড়াইটায় খবর দিই। আমাদের সাথে ব্যাঙ্গালোর হোয়াইট ফিল্ডের পুলিশ স্টেশন যোগাযোগ করতেই আমরা তৎপর হয়ে যাই। রাত দেড়টা নাগাদ নাইট শিফট সেরে ফেরার পথ ম্যাডাম সুহানাকে কারা যেনো ফলো করেছিলো, এবং সুহানা প্রান ভয়ে ভীত হয়ে দৌড়াতেই চলন্ত লরির সামনে স্কুটি সহ পড়ে প্রান হারায়। রোডের সি সি টিভি ফুটেজে এরকমই তথ্য পাওয়া গেছে। এবং ব্যাঙ্গালোর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। সুহানাকে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন একটা শব্দ ই শুধু শোনা গেছে , আকাশ ….। আকাশ যেনো তখন যন্ত্রমানব , কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অস্ফুটে বলে , চলে গেলি ….।
ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে যখন সুহানার নিথর বডি ওখানেই কবর দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন এগিয়ে আসেন ওখানে গোটা মেডিক্যাল অর্গানাইজেশন। এবং তার প্রিয় কর্মভূমি তে তাকে শেষ বিদায় জানানোর মুহূর্তে ডক্টর জাভেদ খান একখানা সিঁদুরের কৌটো আকাশের হাতে ধরিয়ে বলেন , ও খুব চাইতো তোমাকে। ওর শেষ ইচ্ছা পূরন করো। মৃত সুহানার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয় আকাশ। চারিদিক থেকে ফুল এসে ঢেকে দেয় নিষ্পাপ সুহানার প্রানহীন দেহ। আকাশ তখন সুহানাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। উপস্থিত সবার গ্যালারিতে ভিড় জমে ওঠে সেই ছবির।সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই উজ্জ্বল মুহূর্ত। প্রেম যেনো চির অমর অমলিন। সংবাদপত্র জুড়ে শিরোনামে থাকে সেই ছবি, প্রেমের মৃত্যু নেই।আকাশ তারপরেই বোহেমিয়ান হয়ে ওঠে। লেখায় ডুবে যায় আর সুহানাকে ভুলতে তার সঙ্গী হয় মদ। সে যেনো অপ্রকৃতিস্থ থাকতে চায়। বাস্তব জীবন থেকে পালাতে চায়। যাবতীয় সুখ ঐশ্বর্যের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সে যেনো অনন্তের অভিসারে মগ্ন হয়ে ওঠে।
চারটা কেমো নেওয়া হয়ে গেলো। শরীর যেনো আর ধকল নিতে পারছেনা। আকাশ ও অপেক্ষায় কখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে সে। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতময় পৃথিবী ছেড়ে সে সুহানার কোলে মাথা রাখবে। যাবার আগে যদি তার পুরষ্কার টা জোটে তো সুহানাকে গিয়ে বলবে, তোর ইচ্ছা পুরন করে তোর কাছে এসেছি। সে জানে না মহাকাল তাকে সেই সুযোগ দেবে কিনা। এরমধ্যে ডক্টর অনিতার স্বামী আদিত্য বর্মন এসে দেখা করে গেছে আকাশের সাথে। তার গ্যালারি উপন্যাস নিয়ে হিন্দি বাংলা দুটো ভাষাতেই মুভি হবে। এও এক সান্ত্বনা। সুহানার কাছে সে শুধু ব্যার্থ প্রেমিক থাকলো না, তাদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখলো সময়ের ব্যাবধানে। কালোত্তীর্ণ যুগোত্তীর্ন এই পবিত্র প্রেম প্রতিটি মানব মনের গ্যালারিতে বন্দী থাকবে।


এবছর পূজো শরত পেরিয়ে হেমন্তের। হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর যেনো খোলস খসা সাপের মতো নিস্তেজ। মহায়ষষ্ঠীর সকালে বোধনের মহা লগ্নেই খবর আসে পায়েলের ফোন থেকে, যে আকাশের গ্যালারি একাডেমি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। আর আকাশের কোন স্বপ্ন নেই। এবার ডক্টর অনিতার দেওয়া সময়সীমার কথা মনে পড়ে, লাইফ লাইন। হ্যাঁ এটাই তার শেষ উপন্যাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের হিসাব মতো আর থার্টি সেভেন ডেজ সে পৃথিবীতে থাকবে। লাইফ লাইন উপন্যাস টা ডক্টর অনিতাকে উৎসর্গ করে যাবে সে। এমন সময় ডক্টর অনিতা এসে আকাশের মাথার কাছে দাঁড়ায়। আজ মিস্টার আকাশ না বলে, সে ডাকে বন্ধু তোমার বোন আমাকেও ফোন করেছিল। কনগ্রাচুলেশনস, এই নাও তোমার জন্য সুহানার পছন্দের লাল রঙের পাঞ্জাবি এনেছি। এটা আজ পরবে। আকাশ বলে, হ্যাঁ বন্ধু আর কোন চাপ নেই। এবার আমি শান্তিতে যাবো, আর শোনো ওই মুভি থেকে যা আসবে আমার পারসেন্টেজ সবটা দান করে দেবে কোন অনাথ আশ্রমে। ওদের মধ্যেই আমার আর সুহানার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। অবারিত জোছনা ধারায় তখন যেনো ঢেকে যাচ্ছে স্বপ্নের শহর মুম্বাই। আকাশের বুকে সুহানা নামের তারাটা জ্বলজ্বল করছে। দেরী না করে লাইফলাইনের পান্ডুলিপি টা ডক্টর অনিতা বর্মনের হাতে দিয়ে বলে, শেষ অধ্যায় টুকু সাইত্রিশ দিনে না হয় শেষ করবো, এখন এই পূজোর উপহার হিসেবে তোমাকেই দিলাম বন্ধু আমার লাইফলাইন।
আরও পড়ুন
সহযাত্রী
দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন
Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক
উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন। ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন
Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি
উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন