বাঙালি বলেই কি জগদীশ চন্দ্র বসু বেতার যন্ত্র আবিষ্কারকের মর্যাদা পাননি?

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ছবি – এক্স

উত্তরাপথঃ রেডিও বা বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারক হিসেবে গুগলিয়েলমো মার্কোনির নাম সবাই জানে । কিন্তু তার আগেই বেতার যন্ত্র তৈরি করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। বাঙালি বলেই জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কারকের মর্যাদা পাননি? আমাদের রাজ্যে এই ঘটনা নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চালু আছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

জগদীশ চন্দ্র বসু্র গবেষণা ছিল ক্ষুদ্র বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ নিয়ে।পরীক্ষাগারে তিনিই প্রথম ক্ষুদ্র বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তিনি চেষ্টা করছিলেন ক্ষুদ্র তরঙ্গকে রেডিও বা বেতারযন্ত্রের সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠাতে। অবশেষে ১৮৯৪ সালে সফল হয় তাঁর সেই চেষ্টা। ১৮৯৫ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু কলকাতার টাউন হল মাঠে এক জনসভায় বক্তৃতা দেন।সেখানে তিনি বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে বিনা তারে দেয়াল ভেদ করে কীভাবে পাঠানো যায়, সে ব্যাখ্যা দেন। এমনকী তার যন্ত্রটা চালিয়েও দেখান। সারা ভারতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। নাম ছড়ায় ইউরোপেও। ওই বছরই তাঁর কাজ নিয়ে একটা ফিচার ছাপা হলো ইংল্যান্ডের ‘ইলেকট্রিশিয়ান’ পত্রিকায়।

জগদীশ বসুর গবেষণা ও খ্যাতির ফলে বাংলার সরকার তাঁকে নয় মাসের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে পাঠায়। ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির এক সভায় যোগ দেন জগদীশ চন্দ্র বসু। সেই সভায় তিনি বেতারে বার্তা প্রেরণ করে তাঁর কাজের প্রমাণ দেখান। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন লর্ড র‌্যালেসহ আরও অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী।এর এক বছর পর পর ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কোনিও একটা বেতারযন্ত্র তৈরি করেন। অনেকের ধারনা জগদীশ চন্দ্র বসুর যন্ত্রটার নকল করেছিলেন মার্কোনিও। আসলে তা নয়, সেই সময় বেতার যন্ত্র নিয়ে গুগলিয়েলমো মার্কোনি এবং নিকোলা টেসলা সহ একাধিক উদ্ভাবক কাজ করেছিলেন,,তবে জগদীশ চন্দ্র বসু আর মার্কোনি তাঁদের অন্যতম।

জগদীশ চন্দ্র বসু যে ধরনের বেতারযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, তা অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গের বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ বিকিরণ প্রেরণ করতে পারত। আজকের রাডার, টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই ধরনের তরঙ্গের আদান-প্রদান ঘটে। তাই বলা যায় এসব যন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো জগদীশ চন্দ্র বসুর বেতারযন্ত্র। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে দেওয়া তাঁর বক্তব্য শুনে ও পরীক্ষাগুলো দেখে র‌্যালে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এমন নির্ভুল পরীক্ষা আগে কখনো দেখিনি- এ যেন মায়াজাল।’ সেই বক্তৃতার পর বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশ চন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে অভিনন্দন জানান। এরপর জগদীশ চন্দ্র বসুর খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে। সেখানেও বক্তৃতা দেন।

সে সময় ইউরোপের এক বিখ্যাত ইলেকট্রনিক কোম্পানি জগদীশ চন্দ্র বসুর বেতারযন্ত্রের নকশাটা কিনতে চায়। কিন্তু তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি হননি। এর কিছুদিন পরেই মার্কনিও তার বেতারযন্ত্র তৈরি করেন। তখন সেই ইলেকট্রনিকস কোম্পানি মার্কোনির যন্ত্রের নকশাটা কিনে নেয়। ফলে মার্কোনির তৈরি বেতারযন্ত্রই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এছাড়া জগদীশ চন্দ্র বসু এবং মার্কনি উভয়েই একই সময়ে পেটেন্ট দাখিল করেন, যার ফলে পেটেন্ট বিরোধ এবং আইনি লড়াই শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত, মার্কনির পেটেন্ট বহাল রাখা হয় এবং বেতার টেলিগ্রাফির উন্নয়নে তার অবদানের জন্য তিনি ব্যাপক স্বীকৃতি পান। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ চন্দ্র বসুর মনে কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান হলো সাধনা, ব্যবসার বস্তু নয়।

সুতরাং জগদীশ চন্দ্র বসুকে মর্যাদা দিতে গিয়ে বাঙালি বলে জগদীশ চন্দ্র বসু বেতার যন্ত্র আবিষ্কারকের মর্যাদা পাননি এবং ষড়যন্ত্রের যে কথা বলি, সেটা সত্যি নয়। এ কথা বললে, বরং মার্কোনির কৃতিত্বকে ছোট করা হয়। আবার ইউরোপিয়ানরা আমাদের বিজ্ঞানীদের খাঁটো করে দেখেন, সেটাও সত্যি নয়। বরং ব্রিটিশ ভারতের বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে গর্ব করে খোদ ব্রিটিশরাই।ব্রিটিশ বিজ্ঞানে তাঁর আবদানের কারণে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড ২০২০ সালে ঘোষণা করেছিলেন যে  ৫০ ইউকে পাউন্ড কারেন্সি নোটটিকে নতুনভাবে ডিজাইন করবে, এটিকে বিজ্ঞানের বিশ্বের একটি বিশিষ্ট নাম দিয়ে প্রতিস্থাপন করবে। আর আশ্চর্যজনকভাবে ভারতীয় বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম মনোনয়নের তালিকায় স্থান পেয়েছিল এবং এটি মোট ১৭৪,১১২টি মনোনয়ন পেয়েছিল।

সূত্র: ব্রিটানিকা ও উইকিপিডিয়া

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ICC টুর্নামেন্ট জিতলে পুরুষ ও মহিলাদের দল একই অর্থ পাবে

উত্তরাপথ: এবার থেকে ICC টুর্নামেন্ট জিতলে পুরুষ ও মহিলা দলের প্রাইজ মানি একই। ডারবানে বসেছে আইসিসি-র (ICC) বার্ষিক বৈঠক সেখানেই স্থির হয়েছে ।  ICC-র চেয়ারম্যান গ্রেগ বার্কলে বলেছেন, ”ক্রিকেটের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত এটি। আমি অত্যন্ত খুশি যে পুরুষ ও মহিলাদের দল আইসিসি-র ইভেন্টে এবার প্রাইজ মানি হিসেবে একই অর্থ পাবে।” তিনি আরও বলেন, ”২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর আমরা মহিলাদের ইভেন্টের প্রাইজ মানি বাড়িয়ে এসেছি, উদ্দেশ্য ছিল একটাই। মহিলাদের বিশ্বকাপ জয় এবং পুরুষদের বিশ্বকাপ জয়ের আর্থিক পুরস্কার এক হবে .....বিস্তারিত পড়ুন

উত্তর ভারত জুড়ে প্রবল বৃষ্টি ও ভূমিধস

উত্তরাপথ: উত্তর ভারত জুড়ে প্রবল বৃষ্টিতে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, এই অঞ্চলে ভূমিধস এবং আকস্মিক বন্যা হয়েছে, যা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত বলে সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে। সপ্তাহান্তে জাতীয় রাজধানীতে ভারী বৃষ্টিপাতের পরে দিল্লির স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে রাজ্যের লোকেদের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হতে বলেছে কর্তৃপক্ষ। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর এবং পাঞ্জাব রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে বন্যা ও ভূমিধসে অন্তত .....বিস্তারিত পড়ুন

রাতে ভালো ঘুমের পিছনে বিজ্ঞানের রহস্য

উত্তরাপথ: ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যকর জীবনধারার একটি অপরিহার্য উপাদান। রাতের ভালো ঘুম হওয়া বর্তমান সময়ের একটা বড় সমস্যা। অনেকে আবার ভালো রাতের ঘুমের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।এক নতুন গবেষণায়, জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা  বলেছেন ঘুমের দীর্ঘস্থায়ী ও গভীরতা নির্ভর করে মস্তিস্কের কোষগুলির মধ্যে পাঠানো সংকেতের উপর। রাতে ঘুমের সময় শরীরে ঘটে যাওয়া জটিল প্রক্রিয়াগুলি সহ  রাতের বিশ্রামের কি গুরুত্ব আমাদের শরীরের উপর তা নিয়ে .....বিস্তারিত পড়ুন

Renewable Energy: জাপানি প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির প্রস্তাব করেছেন

উত্তরাপথ: সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সাথে নবায়নযোগ্য শক্তিতে (Renewable Energy) দেশের উন্নত প্রযুক্তি ভাগ করার প্রস্তাব করেছেন। মূলত  জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে । সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘদিন ধরে তাদের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদের জন্য পরিচিত, যা তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে উভয় দেশ তাদের কার্বন পদচিহ্ন (Carbon Emission) কমাতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের শক্তির উৎসগুলির পরিবর্তনে আগ্রহী .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top