নিউ মেক্সিকোতে ২৩,০০০ বছর পুরনো মানুষের পায়ের ছাপের বিতর্কিত দাবিকে সমর্থন করে নতুন গবেষণা

ছবি – এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া।

উত্তরাপথঃ ২০২১ সালে নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে আবিষ্কৃত মানব পদচিহ্ন নিয়ে আমেরিকার প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। গবেষণাটি দাবি করেছিল, এই পদচিহ্নগুলি ২৩,০০০ থেকে ২১,০০০ বছর আগের, যা উত্তর আমেরিকায় এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম মানবচিহ্ন। এই আবিষ্কার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বহুদিনের প্রচলিত বিশ্বাসে, যেখানে ধারণা ছিল ক্লোভিস জনগোষ্ঠীই প্রথম উত্তর আমেরিকায় পা রেখেছিল, সেই সময় ছিল শেষ বরফ যুগের শেষাংশ—১৩,০০০ থেকে ১৩,৫০০ বছর আগে।

০২১ সালে, নিউ মেক্সিকোতে গবেষকরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যা আমেরিকান প্রত্নতত্ত্বের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলির একটি। গবেষণায় হোয়াইট স্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে পাওয়া মানুষের পায়ের ছাপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেগুলির বয়স ২৩,০০০ থেকে ২১,০০০ বছর পুরনো, যা উত্তর আমেরিকায় এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম মানবচিহ্ন। এটি দীর্ঘদিনের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে যে প্রথম উত্তর আমেরিকানরা ছিলেন ক্লোভিস জনগোষ্ঠী—নিউ মেক্সিকোর ক্লোভিসের কাছে পাওয়া নিদর্শনের নামে নামকরণ করা—যারা শেষ বরফ যুগের শেষে একটি তুলনামূলকভাবে উষ্ণ সময়ে, ১৩,০০০ থেকে ১৩,৫০০ বছর আগে এসেছিলেন।

যেহেতু পায়ের ছাপগুলি সরাসরি তারিখ নির্ধারণ করা যায় না, গবেষকরা এই ট্রেস ফসিলগুলির বয়স—২৩,০০০ থেকে ২১,০০০ বছর—অনুমান করেছেন পায়ের ছাপের উপরে এবং নীচের স্তরে পাওয়া বীজের রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে। যদিও সমালোচকরা এখনও তর্ক করছেন যে প্রাচীন বীজগুলি সাইটের বয়স সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না, তবে গত সপ্তাহে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা মূল ফলাফলের পক্ষে আরও সমর্থন যোগ করেছে। ফলে, জলজ উদ্ভিদ রুপ্পিয়া সিরোসার বীজগুলি আবারও এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে।

“প্রথম আমেরিকানদের আগমন দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত এবং হোয়াইট স্যান্ডস সাইটের তারিখ নির্ধারণের বৈধতার উপর উল্লেখযোগ্য বিতর্ক কেন্দ্রীভূত হয়েছে,” নতুন গবেষণায় গবেষকরা লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ভূতাত্ত্বিক ভ্যান্স হলিডে, যিনি ২০২১ সালের গবেষণাপত্রের সহ-লেখক। “এই গবেষণাপত্রটি একটি স্বাধীন স্তরবিন্যাস অধ্যয়নের ফলাফল উপস্থাপন করে, যাতে নতুন আপেক্ষিক তারিখ রয়েছে, যা মূলত তৃতীয় উৎস থেকে রেডিওকার্বনের মাধ্যমে প্রাথমিক তারিখ নির্ধারণকে সমর্থন করে।”

নতুন গবেষণায় অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভূতত্ত্ববিদ ভ্যান্স হলিডে এবং তার সহকর্মীরা রূপ্পিয়া নামক জলজ উদ্ভিদের বীজসহ বিভিন্ন জৈব স্তর থেকে নতুন রেডিওকার্বন ডেট সংগ্রহ করেন। ফলাফলে দেখা গেছে, পদচিহ্নযুক্ত স্তরের বয়স ২৩,০০০ থেকে অন্তত ১৭,০০০ বছরের মধ্যে, যা আগের অনুমানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

গবেষণায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া জৈব পদার্থের বয়স ছিল প্রায় ২২,৪০০ থেকে ২০,৭০০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, যদি এই পদচিহ্ন ২৩,০০০ বছরের হয়, তবে তা প্রমাণ করে, মানুষ উত্তর আমেরিকায় এসেছিল শেষ বরফ যুগের চূড়ান্ত পর্যায়েরও আগে। এমনকি যদি বয়স ১৭,০০০ বছর হয়, তবুও মানুষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার (১১,৭০০ বছর আগে) আগেই সেখানে পা রেখেছিল।

সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল গবেষক নিকোলাস ফেলস্টেড বলেন, “এটি আমেরিকায় মানব আগমনের ব্যাপারে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা।” তার মতে, এটি প্রমাণ করে যে উত্তর আমেরিকায় একাধিক পথ ধরে মানুষ এসেছে—বরফমুক্ত করিডোর ছাড়াও বেরিং সাগর, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বা এমনকি সমুদ্রপথেও আগমন ঘটেছে।

চিলির প্যালেওন্টোলজিস্ট কারেন মোরেনো বলেন, এই গবেষণার ফলাফল দক্ষিণ আমেরিকার মন্টে ভার্দে, পিলাউকো, পেড্রা ফুরাদা, ও আর্রোয়ো দেল ভিজকাইনের মতো প্রাচীন সাইটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেসব অঞ্চলেও মানুষ ১৬,০০০ থেকে ২০,০০০, এমনকি ৩০,০০০ বছর আগেও থাকতে পারে বলে প্রমাণ মিলেছে।

অবশ্য ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতি নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে ‘হার্ড ওয়াটার ইফেক্ট’ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই প্রভাব দেখা দেয় যখন জলজ উদ্ভিদ ভূগর্ভস্থ পুরনো চুনাপাথরের দ্রবীভূত কার্বন শোষণ করে, যা রেডিওকার্বন ডেটিংয়ে বস্তুকে আসলে তার চেয়েও অনেক পুরনো বলে প্রতিভাত করে।

জিওআর্কিওলজিস্ট ডেভিড র‍্যাচাল জানান, তাদের মতে রূপ্পিয়া গাছ সেই সময় জন্মায়নি, বরং পরে জলে ভেসে এসেছে। তাই এই বীজের উপর ভিত্তি করে সময় নির্ধারণ করলে ভুল হতে পারে।

এমনকি হার্ড ওয়াটার ইফেক্ট হিসেবেও না ধরলেও, আলাস্কার মানববিদ বেন পটার মনে করেন, পদচিহ্ন থাকলেও অন্য কোনও মানব-নির্মিত বস্তু পাওয়া যায়নি। “এই জনগোষ্ঠীর পরিচয়, আচরণ ও তাদের ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য আমাদের আরও প্রকৃত প্রত্নবস্তু দরকার,” তিনি বলেন।

সর্বশেষ গবেষণা আবারও এই বিতর্কিত “প্রথম আমেরিকান” তত্ত্বে নতুন মাত্রা যোগ করলো। এই অধ্যায় এখন নতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে, এবং প্রতিপক্ষদের প্রতিক্রিয়ার জন্য হয়তো বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। তর্ক চলছেই—কবে, কীভাবে, কোন পথ ধরে মানুষ প্রথম এই মহাদেশে এসেছিল, তার উত্তর খুঁজতেই গবেষকরা ছুটে চলেছেন অতীতের ছায়ার দিকে।

 

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top