রাজস্থানের মনসুন প্যালেস: প্রকৃতির মাঝে এক রাজকীয় আয়োজন

মনসুন প্যালেস , রাজস্থান । ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

উত্তরাপথ; রাজস্থানের উদয়পুর শহরের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে কথা বললে,মনসুন প্যালেস সেরা পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি। মনসুন প্যালেসের পূর্ব নাম ছিল সজ্জনগড় প্রাসাদ । এটি মূলত শহরের একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সজ্জনগড় প্রাসাদটি ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মহারানা সজ্জন সিং তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন মেওয়ার রাজবংশের ৭২ তম রাজা এবং তার নামানুসারে প্রাসাদটির নামকরণ করা হয়েছিল। যেহেতু প্রাসাদটি ‘বর্ষা’ মেঘ দেখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তাই ইদানীং এর নাম মনসুন প্যালেস দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, স্থানীয় মতে মনে করা হয় যে মহারানা সজ্জন সিং এত উচ্চতায় এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন যাতে পৈতৃক বাড়ি চিতোরগড়ের দৃশ্য তিনি দেখতে পান।

মহারানা ফতেহ সিং ও মহারানা সজ্জন সিং । ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত প্রাসাদটি ৯৪৪ মিটার (৩১০০ ফুট) উচ্চতায় আরাবল্লী পর্বতমালার বাঁশদারা চূড়ায় অবস্থিত। মহারানা সজ্জন সিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল একটি নয় তলা কমপ্লেক্স তৈরি করা, যা মূলত তিনি একটি জ্যোতির্বিদ্যা কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন সেইসাথে তিনি এটিকে বর্ষার মেঘের গতিবিধি দেখার জন্য ব্যাবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুর কারণে, তার উত্তরাধিকারী মহারানা ফতেহ সিং দ্বারা প্রাসাদটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল, যিনি এটিকে বর্ষার মেঘ দেখার জন্যই ব্যবহার করেছিলেন।সেইসময় রাজপরিবারও এই ভবনটিকে শিকারের লজ হিসেবে ব্যবহার করত।

ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

বর্তমানে মনসুন প্যালেসটি একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠেছে, যা সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বর্ষাকালে এই প্রসাদটির  অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এখানে আসেন। মনসুন প্রাসাদটি মেওয়ার রাজবংশের স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত এবং অপূর্ব কারুকার্য দ্বারা সজ্জিত, প্রাসাদটি রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক । এর নকশায় রাজপুত এবং মুঘল স্থাপত্যের উপাদান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, বারান্দা এবং ঝাড়োখা (ঘেরা ঝুলানো বারান্দা)।এই প্রাসাদের কৌশলগত অবস্থান প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলের জন্য আদর্শ ,যার ফলে গ্রীষ্মের মাসগুলিতেও এর অভ্যন্তরীণ ঠান্ডা থাকে।

ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

মনসুন প্যালেসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এটি অফার করে বিস্ময়কর প্যানোরামিক দৃশ্য। প্রায় ৯৪৪ মিটার উচ্চতা থেকে পর্যটকরা উদয়পুর শহর, পিচোলা হ্রদ এবং আশেপাশের আরাবল্লী পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখতে পাবেন । এই প্রাসাদ থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্যটি বিশেষভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে, কারণ অস্তগামী সূর্যের সোনালি আভা পুরো প্রসাদের উপর এক জাদুকরী আভা ছড়িয়ে দেয়।

মনসুন প্যালেস ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

এর স্থাপত্য জাঁকজমক এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও, মনসুন প্রাসাদটি তার জীববৈচিত্র্যের জন্যও বিখ্যাত। আশেপাশের এলাকাটি বিভিন্ন বন্যপ্রাণী প্রজাতির জন্য একটি অভয়ারণ্য, যার মধ্যে রয়েছে ময়ূর, বন্য শূকর এবং বিভিন্ন ধরনের পাখি। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান ,এখানে তারা যেমন সবুজ অন্বেষণ করতে পারবে, তেমনি প্রাসাদের আশেপাশের প্রশান্তি উপভোগ করতে পারবে।এটি পাখি দেখার এবং প্রকৃতির মধ্যে হাঁটার জন্য একটি আদর্শ গন্তব্য ।

ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

মনসুন প্যালেস বলিউড এবং হলিউড উভয় ক্ষেত্রেই একটি জনপ্রিয় চিত্রগ্রহণের স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এর চিত্তাকর্ষক সৌন্দর্য এবং মনোরম পরিবেশ তার সাথে রাজস্থানের রাজকীয় ঐতিহ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আকৃষ্ট করেছে। “জেমস বন্ড: অক্টোপসি” এবং “দ্য ফল” এর মতো চলচ্চিত্রগুলি প্রাসাদের অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রদর্শন করেছে, এর বৈশ্বিক আবেদনকে  সারা বিশ্বে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

মনসুন প্রাসাদে পৌঁছানোর জন্য, পর্যটকরা নিজেরা গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে উঠতে পারেন বা গাড়ি ভাড়া নিয়েওপাহাড়ে উঠতে পারেন ।প্রাসাদটি সারা বছর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে, কিন্তু বর্ষা মৌসুমে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত,আদর্শ সময় মনসুন প্রাসাদটি ভ্রমণের জন্য।বর্ষার মেঘের  কুয়াশা প্রাসাদটিকে আবৃত করে  একটি নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি করে ।

ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

সবমিলিয়ে রাজস্থানের রাজকীয় ঐতিহ্যের সাথে এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য এই স্থানের কোনও বিকল্প নেই । এই স্থানে ভ্রমণ আপনাকে সারা জীবন মনে রাখার মত একটি মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা প্রদান করবে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top