ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাত
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-29.png)
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-29.png)
সাবেক মানভূম তথা বর্তমান পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলে কৃষিকাজের অনেকগুলি পর্যায় আছে। প্রথমে জমি তৈরি, তারপর শস্য রোপণ, শস্যের যত্ন করা, শস্য যখন পরিপক্ক তখন তার উপযুক্ত প্রহরার ব্যবস্থা করা, সময়মতো সেই শস্য ঘরে তোলা এবং কর্ষণ পরবর্তী সংরক্ষণ করা। এই pre- harvest technology ও post- harvest technology- কে কেন্দ্র করে পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের কৃষক সমাজে অনেকগুলি প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে । প্রথমেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কৃষককে তার সুযোগ সুবিধা মত কৃষিকাজে প্রবৃত্ত হতে বলেন। কারণ সেটি ই কৃষকের প্রাথমিক কাজ।
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-30.png)
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-30.png)
যেদিন রস
সেদিন চষ্।
( শব্দার্থ : রস – ‘রস’ অর্থে মাটির সজীবতা বা সরসতাকে বোঝানো হয়েছে।
চষ্ – ‘চষ্’ অর্থে চাষের কাজ করাকে বোঝানো হয়েছে। )
ব্যাখ্যা : আলোচ্য প্রবাদটিতে কৃষিকার্যের মূল সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতিনীতি বা বিধিবদ্ধ নিয়ম কখনই চরম সত্য নয়। চাষের অনুকূল পরিবেশ- পরিস্থিতিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, উৎকৃষ্ট ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসল পেতে গেলে দিন, তিথি, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি শুভক্ষণের চেয়ে চাষের অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাটি সজীব থাকলে চাষের কাজের অধিকাংশই করা যায়। জমিতে লাঙ্গল দেওয়া, জমি মেরামত করা, আগাছা পরিষ্কার করা, বীজ বপন করা প্রভৃতি চাষের কাজগুলি মাটির সজীবতার উপর নির্ভর করেই করা হয়।
কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামবাংলায় দীর্ঘ জীবন- অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আলোচ্য প্রবাদটির উদ্ভব হয়েছে। এই প্রবাদটিতে কৃষকসমাজের প্রতি চাষের অনুকূল পরিবেশ বিষয়ে একটি সাধারণ নির্দেশ রয়েছে। এ সম্বন্ধে প্রচলিত লোকবিশ্বাস হলো যে বার- তিথি- নক্ষত্র নির্বিচারে অনুকূল পরিবেশে চাষ করলে ফলন অবশ্যই ভালো হয়।
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-31.png)
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-31.png)
মানুষের জীবনে আলোচ্য প্রবাদটির প্রাসঙ্গিকতা-
ব্যবহারিক জীবনেও দেখা যায় যে অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতির যদি আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারি তাহলে অধিক সাফল্য পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যেও একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে : Strike the iron while it is hot.
ফসলের উপযুক্ত মাটি প্রস্তুত করা কৃষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ ফসল আমন ধান চাষের ক্ষেত্রে স্পষ্ট চারটি পর্যায়ে মাটি প্রস্তুতকরণের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে –
উগাল, সামহাল, জাবড়, কাদা-
চারে লিয়েঁ চাষ।
শব্দার্থ: উগাল- জমিতে প্রথমবার লাঙ্গল দেওয়ার কাজ,
সামহাল – জমিকে দ্বিতীয়বার কর্ষণ করা।
জাবড় – জমিতে তৃতীয়বার লাঙ্গল দেওয়ার কাজ।
কাদা – জমিতে চতুর্থ বার লাঙ্গল দেওয়ার কাজ অর্থাৎ চারা রোপণের আগে জমিতে শেষবারের মতো লাঙ্গল দিয়ে কর্দমাক্ত- থকথকে অবস্থা সৃষ্টি করা।
ব্যাখ্যা: ধান চাষের জন্য জমিতে চারবার লাঙ্গল দেওয়া প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গেই আলোচ্য প্রবাদটি পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ধানের উৎকৃষ্ট ফসলের জন্য লাঙ্গল দেওয়ার এই চারটি পর্যায় এতদ্ অঞ্চলে মেনে চলা হয়। বর্ষার শুরুতেই ধান জমিতে প্রথমবার লাঙ্গল দেওয়া হয়। একে উগাল বলা হয়। জমিতে যখন জল জমে তখন দ্বিতীয়বার কর্ষণ করা হয়। একে সামহাল বলে। সামহালের তিন-চার দিন পর জমিতে তৃতীয়বার লাঙ্গল দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে জাবড় বলে। এরপর সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন পরে ওই জমিতে চতুর্থ বার বা শেষবারের মতো লাঙ্গল দেওয়া হয়। একে কাদা বলে। কাদার পর জমিটি চারা গাছ রোপণের উপযোগী হয় এবং ওই দিনেই জমিতে ধানের চারা রোপণ করা হয়।
পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের কৃষক সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে উপরোক্ত চারটি পর্যায়ে ধানের চারা রোপণের জন্য জমি তৈরি না করলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না; তথা ফসলের পরিমাণগত ও গুণগত মান নেমে যায়।
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-32.png)
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-32.png)
মানুষের জীবনে আলোচ্য প্রবাদের প্রাসঙ্গিকতা –
একজন শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে অনুরূপভাবে একাধিক পর্যায়ে অতিক্রম করতে হয়। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা বা পেশাদারি শিক্ষা ইত্যাদি। সাধারণ অজ্ঞ মানুষও কাজ করতে করতে বিভিন্ন পর্যায়ে অতিক্রম করে এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে।
ঘন কুত্থি , বিরল তিল
ডেগে ডেগে পাট,
এমনভাবে বুনবি কাপাস
যেন না ঢুকে বাতাস।
( শব্দার্থ : ডেগে ডেগে – প্রতি পদক্ষেপে, এক পদক্ষেপ স্থান দূরে দূরে )
ব্যাখ্যা : আলোচ্য প্রবাদটি হল কৃষিকেন্দ্রিক গ্রাম-বাংলায় প্রচলিত বীজ বোনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রবাদ । দীর্ঘ জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এই প্রবাদে বলা হয়েছে কুত্থি বীজ ঘন ভাবে বপন করতে হয় । আর তিল বপনের পদ্ধতি হলো, দূরে দূরে কম পরিমাণ বীজ ছড়িয়ে দিতে হয় । অনেকে তিল বীজ বপন করার সময় তিলের সাথে বালি মিশিয়ে বীজ ছড়ায় । এর উদ্দেশ্যই হলো বীজ যাতে ঘন ভাবে বোনা না হয়। ডেগে ডেগে অর্থাৎ এক পদক্ষেপ দূরে দূরে পাট বুনতে হয় । কার্পাস বীজ বোনার পদ্ধতি একটু স্বতন্ত্র । অত্যন্ত ঘন ভাবে কার্পাস বীজ বুনতে হয় । যাতে তার মধ্যে যেন বাতাসও প্রবেশ করতে না পারে। এইভাবে বীজ বপন করলে ফসল ভালো হয়।
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-33.png)
![](https://uttarapath.com/oogokoab/2023/04/image-33.png)
কৃষক বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে উপরোক্ত পদ্ধতিতে উপরোক্ত বীজগুলি বপন করলে ফসলের পরিমাণগত ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
মুলার মাটি ধুলা, আর আলুর মাটি তুলা।
( শব্দার্থ : তুলা – ‘ তুলা ‘ শব্দটি এখানে নরম ও আলগা মাটি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।)
ব্যাখ্যা : বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে মুলার বীজ বপনের সময় যদি মাটি শুকনো ও গুঁড়ো ধুলার মতো করা হয় তাহলে মুলার উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত মান বৃদ্ধি পায় । অনুরূপভাবে আলু চাষের ক্ষেত্রেও দেখা যায় , বীজ বপনের সময় যদি মাটি নরম ও আলগা অর্থাৎ ঝুরঝুরে থাকে তাহলে সেই মাটিতে আলোর উৎপাদন গুণগত ও পরিমাণগত – উভয় দিক থেকেই বেশি হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে , আলোচ্য প্রবাদটিতে মুলা ও আলু চাষের ক্ষেত্রে অনুকূল মাটি তৈরির কথা ব্যক্ত হয়েছে । এক্ষেত্রে প্রচলিত লোকবিশ্বাস হলো যে , উপরোক্ত পদ্ধতিতে মুলা ও আলু চাষ করলে ফলন ভালো হবেই।
এছাড়াও কৃষিপদ্ধতি সংক্রান্ত অনেক প্রবাদ এই অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষদের দীর্ঘ জীবন-অভিজ্ঞতা ও জীবনচর্যা প্রকাশ লাভ করেছে এই কৃষি কেন্দ্রিক প্রবাদগুলির মধ্য দিয়ে । এগুলি এখানকার চাষিবাসি মানুষদের কৃষিভাবনার জীবন্ত দলিল।
Pingback: Manbhum Sanskriti: মানভূমের কৃষিকেন্দ্রিক ব্যঙ্গাত্মক প্রবাদ - উত্তরাপথ