

আলাদা আলাদা কোণ থেকে শনির বলয়-এর দৃশ্যমানতা| ছবিটি Star Walk নামক এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত|
ড. সায়ন বসু: গ্যালিলিও গ্যালিলেই তার নিজের ছোট টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ১৬১০ সালে শনির বলয়গুলি প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তবে তার টেলিস্কোপের তেমন ক্ষমতা ছিল না, যা দিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে এই বলয়গুলির বৈশিষ্ট্য দেখাতে পারতেন। তিনি সেগুলিকে উপগ্রহ হিসেবে দেখেছিলেন, মনে করেছিলেন এগুলি শনির চাঁদ। ১৬১২ সালে যখন তিনি আবার শনির দিকে তার টেলিস্কোপ তাক করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে উপগ্রহগুলি অদৃশ্য হয়ে গেছে! পরে, আকর্ষণীয়ভাবে, গ্যালিলিও অবশেষে দেখলেন যে উপগ্রহগুলি ফিরে এসেছে।
আমাদের মধ্যে কতজন খেয়াল করেছেন জানি না তবে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে শনির বিখ্যাত বলয়গুলি আবার কার্যত ‘অদৃশ্য’ হয়ে গিয়েছিল! এর আগে ২০০৯ সালে শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল| আসলে প্রতি ১৩ থেকে ১৫ বছর অন্তর, শনি গ্রহের বলয়গুলি আমাদের দৃষ্টিসীমার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে এক সরলরেখায় অবস্থান করে, যার ফলে এগুলি পৃথিবী থেকে প্রায় অদৃশ্য মনে হয়। এই ক্ষণস্থায়ী ঘটনাটি “রিং প্লেন ক্রসিং” নামে পরিচিত| এই মহাজাগতিক ঘটনাটি ঘটে রবিবার (২৩ মার্চ) ভারতীয় সময় রাত ১০টা নাগাদ, যখন পৃথিবী, শনির বলয় সমতলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।


রিং-প্লেন ক্রসিং এর সময় শনির ছবি| এটি Damian Peach নামক এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত|
দুর্ভাগ্যবশত, এই রিং প্লেন ক্রসিং বেশিরভাগ আকাশ পর্যবেক্ষকদের জন্য দেখা সম্ভব ছিল না। মধ্য-উত্তর অক্ষাংশে অবস্থানকারীদের জন্য, শনি ভোরের আগে সূর্যের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং সকাল বেলার এক্লিপটিকের অনেক নিচে থাকে, যার ফলে এটি দেখা কঠিন। তবে মধ্য-দক্ষিণ অক্ষাংশে থাকা পর্যবেক্ষকদের জন্য শনিকে বলয়হীন অবস্থায় দেখার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি| বলয়যুক্ত গ্রহ শনি সূর্যকে ঘিরে একবার ঘুরে আসে প্রতি ২৯.৪ পৃথিবী বছরে (১ পৃথিবী বছর=৩৬৫ দিন)। এই চক্র চলাকালীন, পৃথিবী থেকে শনির বলয়গুলোর দৃশ্যমানতা পরিবর্তিত হয়, কারণ গ্রহটি ২৭ ডিগ্রি হেলানো একটি অক্ষের চারদিকে ঘোরে। কখনও কখনও এর বলয়গুলি এমনভাবে হেলানো থাকে যে আমরা সেগুলিকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, আবার কখনও সেগুলি এমনভাবে অবস্থান করে যে আমরা সেগুলিকে একেবারে সরু একটি রেখার মতো দেখি বা একেবারেই দেখতে পাই না, কারণ তখন সেগুলি শনির ডিস্কের ওপর সরলরেখায় অবস্থান করে।
শনির বলয়গুলি মূলত জলীয় বরফ দিয়ে তৈরি, সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট শিলা ও ধুলিকণার কণিকা। ধারণা করা হয়, এই বলয়গুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত ধূমকেতু, গ্রহাণু বা ভেঙে পড়া উপগ্রহের অবশিষ্টাংশ, যা শনির প্রবল মাধ্যাকর্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যদিও শনির বলয়গুলি প্রায় ১,৭০,০০০ মাইল (২৭৩,৬০০ কিলোমিটার) জুড়ে বিস্তৃত, কিন্তু এগুলি মাত্র ৩০ ফুট (১০ মিটার) পুরু, যার ফলে যেকোনো কোণ থেকে দেখলে এগুলিকে খুব পাতলা ও হালকা কুয়াশার মতো মনে হয়। তবে যখন এই বলয়গুলি পৃথিবীর সঙ্গে সরলরেখায় অবস্থান করে (edge-on alignment), তখন তারা খুব সামান্য আলো প্রতিফলিত করে এবং এগুলিকে প্রায় দেখা যায় না। সূর্যকে ঘিরে শনির কক্ষপথে ঘোরার সময়, গ্রহটির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। যখন শনি আমাদের দিকে হেলানো অবস্থায় থাকে, তখন আমরা তার বলয়গুলির উপরের দিকটি দেখতে পাই। আবার যখন শনি আমাদের থেকে দূরে হেলে থাকে, তখন আমরা এর বলয়গুলির নিচের দিকটি দেখি। পৃথিবী যখন এই দুটি দৃষ্টিকোণের মধ্যবর্তী অবস্থানে চলে আসে, তখন আমরা শনির বলয় সমতলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করি। এর ফলে, আমরা শনিকে এমনভাবে দেখি যাতে তার বলয়গুলি সরলরেখায় থাকায় সেগুলি দৃশ্যত অদৃশ্য হয়ে যায়, এবং শনিকে একটি বলয়বিহীন গ্রহের মতো মনে হয়।
গত সাত বছর ধরে শনির বলয়গুলি ধীরে ধীরে এমনভাবে হেলেছে যে তারা পৃথিবীর দৃষ্টিকোণে প্রায় সরলরেখায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তবে সৌভাগ্যবশত, এই সরলরেখায় দেখাটিও একটি অস্থায়ী ঘটনা মাত্র। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বলয়গুলি আবার ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে হেলতে শুরু করে এবং প্রথমে একটি সরু রেখার মতো দেখায়। পরবর্তী কয়েক মাসে, এই বলয়গুলি ক্রমশ আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। ২০৩২ সালে, বলয়গুলি পৃথিবী থেকে আবারও সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যাবে, কারণ তখন তারা সর্বোচ্চ হেলানো অবস্থায় থাকবে। যদিও এই বছরের শেষে আর একটি সুযোগ আসবে, ২৩ নভেম্বর, যখন শনির বলয়গুলি প্রায় সরলরেখায় থাকবে।
*লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand এ পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত|
আরও পড়ুন
Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক
উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন। ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন
Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি
উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন
বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন