ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী, টোকিও, জাপান
ছেলেবেলায় পুজোর সময় আঁকার প্রতিযোগিতা হলেই দেখতাম ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দূরে পাহাড়, ছোট ছোট খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ি, চাষের জমি, ফুলের বাগান ঘেরা গ্রামের ছবি আঁকতো। শহরে বড় হওয়ায় অনেকটা বয়স পর্যন্ত শরতের গ্রাম্য রূপ দেখার সুযোগ হয়নি, তাই আমি নিজেও কতবার সেরকম স্থান কল্পনা করে রং তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছি। দূর্গা পূজার সাথে শরতের এই অপূর্ব গ্রাম্য শোভা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর বছরের এই সময়টা এলেই মন সেরকম কোনো স্থানে হারিয়ে যেতে চায়। কর্মসূত্রে ঘর থেকে অনেক দূরে ‘সামুরাইদের দেশ’ জাপানে আমার বর্তমান বসতি। এবছর পুজোয় বাড়ি ফেরা হচ্ছে না জেনেই বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম মহালয়ার দিনে একবার ঘুরে আসবো জাপানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান শিরাকাওয়া-গোর ঐতিহাসিক ওগিমাচি গ্রামটি থেকে।


যদিও এই গ্রামটিতে পর্যটকদের ঢল সারাবছরই কম বেশি থাকে কিন্তু শীতে তুষারাবৃত্ত গ্রাম দেখার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি হয় সাধারণত। কিন্তু আমার মন ভিনদেশের মাটিতে খুঁজছিল এক টুকরো শরতের কাশবন , নীল আকাশ আর সবুজ গ্রামকে। তাই সময় নষ্ট না করেই টোকিও স্টেশন থেকে সিনকানসেন ধরে পৌঁছে গেলাম তোয়ামা শহর। আর সেখান থেকে এক্সপ্রেস বাস ধরে ঘন্টা দুয়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গিফু এবং তোয়ামা প্রিফেকচার এর সীমান্ত ঘেঁষে চলা শোগাওয়া নদীর উপত্যকায় অবস্থিত একাদশ শতাব্দী থেকে টিকে থাকা গ্রাম শিরাকাওয়া-গো। এরা ঐতিহ্যবাহী গাশো-জুকুরি বাড়িগুলির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ, যার মধ্যে কিছু বাড়ির বয়স ২৫০ বছরেরও বেশি।


আমাদের বাসটি শিরাকাওয়া-গো বাস টার্মিনালে থামলো সকাল ১১টায়, এটি গ্রামে ঢোকার ঠিক শুরুতেই রয়েছে। সেখান থেকে সবাই নিজের ইচ্ছে মতন পথ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের চারপাশে। আমি গ্রামে না ঢুকে প্রথমে হাঁটা লাগলাম তেনশুকাকু অবসারভেটরির দিকে। সেখান থেকেই দৃষ্টিনন্দন এই গ্রামের সম্পূর্ণ ল্যান্ডস্কেপটি সুন্দরভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ওখানে পৌঁছে অবাক দৃষ্টিতে দেখলাম আর মনে মনে বললাম ” আরে এই তো সেই ছেলেবেলার কল্পনার গ্রাম!” সেই সবুজ পাহাড়ে ঘেরা খড়ের চালার গ্রাম্য বাড়ি, ধানের খেত ফুলের বাগান সব আছে যা শৈশবের কল্পনায় দেখেছি।মুহূর্তের মধ্যে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। বেশ কিছুটা সময় সেখানে কাটালাম। কিন্তু সময় সীমিত তাই গ্রামে ফেরার পথ ধরলাম। সদ্য পেকে ওঠার হলুদ ধান ক্ষেত্, সাদা ফুলের বাজরার ক্ষেত কিংবা পতিত ঘাস জমি ভরে ওঠা রঙিন কসমস ফুলের ঝোপ অতিক্রম করে অবশেষে গ্রামে পৌছালাম। তবে এই ক্ষেত্রে বলে রাখতে চাই হাঁটা পথের পাশাপাশি অবসারভেটরিতে আসার জন্য আছে শাটল বাসরুটও।


শুরুতেই ঐতিহ্যবাহী গাশো-জুকুরি বাড়িগুলির কথা বলেছিলাম যার প্রকৃত অর্থ হলো “প্রার্থনারত হাত নির্মাণ”, মানে খড় দিয়ে তৈরি হওয়া এই ছাদ গুলো তির্যক ও ঢালু হওয়ায় প্রার্থনারত দুইটি জোড়বদ্ধ হাতের মত দেখায়। এই ধরনের নকশা আশ্চর্যজনক ভাবে পোক্ত হয়, এবং বাড়িগুলোকে শীতের তীব্র তুষারপাতের ফলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।


তাছাড়া এই বাড়ির ঘরগুলো বেশ বড় হয়, তিন থেকে চার তল বিশিষ্ট হয় ,সম্পূর্ণ পরিবার বাস করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শিল্পের জন্য প্রচুর ফাঁকা জায়গা থাকে। গাশো শৈলীর ঘরগুলি ঠিক এই কারণেই অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাড়িগুলির থেকে আলাদা হয়। বাড়ির চিলেকোঠাগুলোতে এডো যুগ থেকে শুরু করে প্রাক শোয়া যুগ পর্যন্ত রেশম উৎপাদনই ছিল মূল শিল্প যা গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা প্রদান করতো। এসব কিছু তথ্য আরো বেশি করে জানার জন্য এবং এই বাড়িগুলোর অন্দরমহল দর্শনের জন্য অবশ্যই এখানকার সংরক্ষিত বাড়িগুলো ঘুরে দেখবেন।


আমি যেমন ওয়াদা হাউস ঘুরে দেখেছি যা কিনা এডো যুগের শেষের দিকে নির্মিত (১৬০৩-১৮৬৭), এই বাড়িটি ওয়াদা পরিবারের সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদাকে প্রতিফলিত করে। এখান থেকে বের হতেই চোখে পড়লো গ্রামের আনাচে কানাচে ফুটে থাকা কাশফুলগুলোর দিকে। অশ্বিনের শারদপ্রাতে অজানা দেশের অচেনা গ্রামে একা ঘুরে বেড়াতে গিয়ে অনুভূত হলো এক বৃহৎ সত্য, মাতৃ আগমন দেশ কাল ভেদে সভ্যতার পর সভ্যতা এই একই সৌন্দর্যের সাথে ঘটবে কিন্তু আমরা ক্ষণস্থায়ী তাই প্রতি মুহূর্ত তার উপস্থিতিকে উপলব্ধ করে প্রকৃতির প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া আর ভবিষ্যত প্রজন্মও যাতে সেই সব কিছু অনুভব করতে পারে সেই শিক্ষা বা চেতনা প্রদান করা। আরো বেশ কিছু সময় গ্রামের এপ্রান্ত সেপ্রান্ত ঘুরে ক্লান্ত হয়ে খেতে ঢুকলাম এখানকারই এক রেস্তোরাঁয় যেখানে পাহাড়ি শাক সবজি মাছ দিয়ে বানানো চমৎকার সব ঐতিহ্যবাহি পদ পাওয়া যায়। বেলাশেষে মন ও উদরের প্রশান্তি ঘটিয়ে ঘরমুখী বাস ধরে ফিরে চললাম শহরের দিকে সেই সাথে ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম অনেক স্মৃতি।


আরও পড়ুন
Vitamin-D: ভিটামিন ডি’র সেবন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়
উত্তরাপথ: হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগগুলি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।সম্প্রতি একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন ডি সম্পূরকগুলি ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোকেদের হার্ট অ্যাটাক সহ যে কোনও বড় ধরনের কার্ডিওভাসকুলার অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে পারে৷ গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি প্রায়ই "সানশাইন ভিটামিন" হিসাবে পরিচিত। এটি গ্রহণকারীদের মধ্যে স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগ ৯% হ্রাস পেয়েছে । যা ২৮ জুন দ্য বিএমজে দ্বারা প্রকাশিত একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Banarasi Saree: ভারতের হৃদয় থেকে একটি কালজয়ী ধন
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: ভারত তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত, এবং ভারতীয় কারুশিল্পের সবচেয়ে আইকনিক প্রতীকগুলির মধ্যে একটি হল বেনারসি শাড়ি। জটিল ডিজাইন এবং বিলাসবহুল কাপড় দিয়ে বোনা, বেনারসি শাড়ি ভারতীয় মহিলাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এবার আসাযাক ভারতের প্রাচীন শহর বারাণসী থেকে ভারতীয় ফ্যাশনের একটি কালজয়ী ধন হয়ে ওঠার বেনারসির যাত্রা। বেনারসি শাড়ির উৎপত্তি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রাচীন শহর বারাণসী (পূর্বে বেনারস নামে পরিচিত) থেকে বলে .....বিস্তারিত পড়ুন
Gond Tribe: মধ্য প্রদেশে গোন্ড উপজাতির সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: গোন্ড উপজাতি(Gond tribe) বিশ্বের বৃহত্তম উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি। এটি ভারতের বৃহত্তম উপজাতি । এদের গায়ের রং কালো, চুল কালো, ঠোঁট মোটা, নাক বড় ও ছড়ানো। তারা অলিখিত ভাষা গোন্ডি ভাষাতে কথা বলে, যা দ্রাবিড় ভাষার সাথে সম্পর্কিত। গোন্ড উপজাতির একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, বিশ্বাস করা হয় যে তাদের শিকড় প্রাক-আর্য যুগে্র । গোন্ডদের সবচেয়ে গৌরবময় রাজা ছিলেন সংগ্রাম শাহ এবং দলগত শাহ, যারা ম্ধ্যপ্রদেশের গন্ডয়ানা রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় অনেকগুলি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দলগত .....বিস্তারিত পড়ুন
রাতে ভালো ঘুমের পিছনে বিজ্ঞানের রহস্য
উত্তরাপথ: ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যকর জীবনধারার একটি অপরিহার্য উপাদান। রাতের ভালো ঘুম হওয়া বর্তমান সময়ের একটা বড় সমস্যা। অনেকে আবার ভালো রাতের ঘুমের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।এক নতুন গবেষণায়, জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছেন ঘুমের দীর্ঘস্থায়ী ও গভীরতা নির্ভর করে মস্তিস্কের কোষগুলির মধ্যে পাঠানো সংকেতের উপর। রাতে ঘুমের সময় শরীরে ঘটে যাওয়া জটিল প্রক্রিয়াগুলি সহ রাতের বিশ্রামের কি গুরুত্ব আমাদের শরীরের উপর তা নিয়ে .....বিস্তারিত পড়ুন