সম্পাদকীয়

 বিশ্ব উস্নায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন

  বিশ্ব উস্নায়ন এবং তাকে কেন্দ্র করে জলবায়ু পরিবর্তন একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি  ধীরে ধীরে একাধিক উপায়ে মানব সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এটি প্রায় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।ইতিমধ্যে এটি আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং আমাদের জীবন যাত্রার উপর ব্যাপক ভাবে প্রভাব দেখাতে শুরু করেছে ।

সদ্য হয়ে যাওয়া হিমাচল প্রদেশের বন্যা আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিল । এবছর হিমাচল প্রদেশে বর্ষাকালে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে ,যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বহু গুণ বেশী।  ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হিমাচল প্রদেশে ১ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪৯.৬ মিমি যা স্বাভাবিক গড় ৭৬.৬ মিমি থেকে প্রায় ৭০% বেশী । ক্লাইমেট চেঞ্জ সেন্টার কাউন্সিল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি হিমাচল প্রদেশের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট এস এস রনধাওয়া বলেন, অত্যধিক তাপ এবং বৃষ্টিপাত, এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।  এবার মার্চে হিমাচলে প্রচণ্ড গরম ছিল, এই গরমের কারণে তুষার খুব দ্রুত গলে যায় তাই এবছর হিমাচলে রেকর্ড সংখ্যক বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে ,যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বহু গুণ বেশী ।

বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকে এর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে করেন।একটানা ভারি বর্ষণের কারণে হিমাচল প্রদেশে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।  ২৯ শে জুন হিমাচলে বর্ষা প্রবেশের পর থেকে ২৪৪ জন মারা গেছে, ৫৪৩ টি ঘরবাড়ি এবং ৪৬৬টি গোয়ালঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  অনেক জায়গায় রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।  এখন পর্যন্ত মোট ১২১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

 এক সপ্তাহের,ভারী বর্ষণ রাজ্যে এমন বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল যে ভূমিধস এবং বন্যার প্রায় ২০০টি ঘটনা ঘটেছে।প্রাথমিক ভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে মারা গেছেন ৩৯ জন।  ১১৩টি ঘরবাড়ি ও ১৬৯ টি গোয়ালঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  এক সপ্তাহে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।তবে হিমাচল প্রদেশে এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন।

তাদের মতে, রাজ্যটির অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত  উন্নয়ন  রাজ্যটির ক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে।রাজ্যে অনেক নতুন মহাসড়ক তৈরি করা হয়েছে, পুরানো মাটির ঘরগুলিকে কংক্রিটের বাড়িতে আপগ্রেড করা হয়েছে, নতুন হোটেল তৈরি হয়েছে এবং সেখানে অবৈধ নির্মাণ হয়েছে এবং সেই সাথে নদীতীর দখলও হয়েছে, যা রাজ্যটিতে বন্যার সম্ভাবনাকে আরও বহুগুণ বাড়িযে দিয়েছে।

পরিবেশবিদদের মতে বছরের পর বছর ধরে নদীর তলদেশে ক্রমাগত নির্মাণ একটি বড় উদ্বেগের বিষয় এবং সরকারের অসদাচরণকে উন্মোচিত করে। নদীর তলদেশ দখল শুধুমাত্র এলাকাটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতাই বৃদ্ধি করেনি বরং এটিতে ধ্বংসের তীব্রতাও বাড়িয়ে দিয়েছে। কুল্লু, মানালি এবং মান্ডিতে আমরা দেখেছি যে নদীর তলদেশে নির্মাণকাজ নদীর স্বাভাবিক গতিপথ এবং জলপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। এবারের এই আকস্মিক বন্যা এই নির্মাণগুলিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে । 

পরিবেশবিদ অশ্বানি শর্মা পাহাড়ে উচ্ছৃঙ্খল এবং অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ অনুশীলন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।তার মতে “সাম্প্রতিক বন্যার সময়, আমরা দেখেছি বন্যার জলের সাথে  নির্মাণ সামগ্রীর যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। নির্মাণ সামগ্রীর এই স্রোত ক্ষতির পরিমাণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল। রাজ্য সরকার সহ কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যাপারে  পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং প্রবিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন।“

বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী  যা মানুষ সহ অন্যান্য জীবজন্তুর জন্য এক উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে । জলবায়ুর পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। সমষ্টিগত পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, নীতিগত হস্তক্ষেপ, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং শিক্ষার ব্যাপক প্রসার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলিকে প্রশমিত করতে পারে। সেইসাথে  এটি একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে, আমরা একটি  স্থিতিস্থাপক, ন্যায়সঙ্গত এবং জলবায়ু-সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top