১লা ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অষ্টগ্রহের মিলন

২৫শে জানুয়ারী Planetary Parade-এর একটি ছবি। এটি Museum of Science নামক এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত।

ডঃ সায়ন বসুঃ  এক ঐতিহাসিক মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে পৃথিবীবাসী। রাতের আকাশে একসঙ্গে সৌরজগতের সমস্ত গ্রহকে দেখতে পাওয়ার অনন্য অভিজ্ঞতা হতে চলেছে আমাদের। ২০২৫ সালে, রাতের আকাশে সৌরজগতের সমস্ত গ্রহকে একসঙ্গে দেখার বিরল সুযোগ রয়েছে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই মহাজাগতিক দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। বিশেষ করে, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে একটি “গ্রহ প্যারেড” (Planetary Parade) ঘটবে, যেখানে বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, এবং নেপচুন একসঙ্গে আকাশে সারিবদ্ধ হবে। এই সময়, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, এবং শনি খালি চোখে দেখা যাবে, তবে ইউরেনাস এবং নেপচুন দেখতে দূরবীন বা টেলিস্কোপের প্রয়োজন হবে। শুক্র গ্রহ সবচেয়ে উজ্জ্বল থাকবে, এরপর বৃহস্পতি ও শনি। মঙ্গল তার স্বাভাবিক কমলা আভা নিয়ে দৃশ্যমান হবে। এই মহাজাগতিক দৃশ্য উপভোগ করতে, সূর্যাস্তের পরপরই পর্যবেক্ষণ শুরু করা উচিত, কারণ এই সময় গ্রহগুলি সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। আলো দূষণ কম এমন স্থানে গিয়ে আকাশ দেখলে অভিজ্ঞতাটি আরও মনোরম হবে। 

এই ঘটনা, যা একদিকে বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার এক অসাধারণ সুযোগ, অন্যদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী সাধারণ মানুষের কাছে এক গভীর আকর্ষণ, সারা পৃথিবী জুড়ে উৎসাহের জন্ম দিয়েছে। সৌরজগতের গ্রহগুলি তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরতে থাকে এবং প্রতিটি গ্রহের কক্ষপথের সময়কাল ভিন্ন। ফলে, একসঙ্গে সমস্ত গ্রহকে একই সময়ে আকাশে দেখা যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। এই বিশেষ পরিস্থিতি ঘটে যখন গ্রহগুলি তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে এমনভাবে অবস্থান করে যে, পৃথিবী থেকে দেখলে তারা একই সরলরেখায় বা একই কোণে অবস্থান করছে বলে মনে হয়। মঙ্গল, শুক্র, বৃহস্পতি, শনি এবং বুধের মতো উজ্জ্বল গ্রহগুলিকে সহজেই খালি চোখে দেখা যাবে। এই গ্রহগুলির উজ্জ্বলতা এবং আকাশে তাদের অবস্থান নির্ভর করছে সূর্যের আলো প্রতিফলনের ওপর। এই মহাজাগতিক দৃশ্যের সময়কাল সংক্ষিপ্ত হতে পারে, তাই এটি দেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। সূর্যাস্তের পর থেকে রাত গভীর হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে এই গ্রহগুলি আকাশের বিভিন্ন স্থানে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। একটি পরিষ্কার এবং দূষণমুক্ত আকাশ এই অভিজ্ঞতাকে আরও স্মরণীয় করে তুলতে পারে। 

এই ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও অত্যন্ত শিক্ষামূলক। সৌরজগতের প্রাকৃতিক কাঠামো এবং গ্রহগুলির অবস্থানগত পরিবর্তনের সাথে পরিচিত হওয়ার এটি একটি দুর্দান্ত সুযোগ। এছাড়া, গবেষকরা এই সময় গ্রহগুলির আলোর বর্ণালীর তথ্য সংগ্রহ করে তাদের গঠন এবং আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেন। এই মহাজাগতিক দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে সৌরজগতের জটিলতা এবং মহাবিশ্বের বিশালতা। তাই এখন রাতের আকাশ শুধু দেখার বিষয় নয়, বরং মহাবিশ্বের এক অনন্য বিস্ময়কে অনুভব করার একটি সুযোগ। পরিকল্পনা করে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, হয়তো একটি টেলিস্কোপের সাহায্যে, আপনি দেখতে পারবেন এই মহাজাগতিক চমক। এই বিরল মহাজাগতিক ঘটনাটি কেবলমাত্র এক সন্ধ্যার সৌন্দর্য নয়, বরং এটি আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অজানা অধ্যায়ের প্রতি আকর্ষণের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

২০২৫ সালে রাতের আকাশে সৌরজগতের সমস্ত গ্রহকে একসঙ্গে দেখার ঘটনা ভারত থেকেও দেখা যাবে। এই বিরল মহাজাগতিক দৃশ্য উপভোগ করতে ভারতের বেশিরভাগ জায়গাই উপযুক্ত। তবে বড় শহরের আলো দূষণ এই অভিজ্ঞতাকে ব্যাহত করতে পারে। তাই গ্রাম বা পাহাড়ি অঞ্চল বেছে নেওয়া ভালো। সঙ্গে আবহাওয়া পরিষ্কার এবং মেঘমুক্ত থাকলে দৃশ্যমানতা ভালো হবে। ভারতে বেঙ্গালুরুর কাছে নন্দি হিলস বা কর্ণাটকের চিক্কামাগালুরু এই পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ স্থান। গোয়াতেও দারুণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ রয়েছে, যেখানে অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্রেন্ডস অব অ্যাস্ট্রোনমি (AFA) বিভিন্ন স্থানে টেলিস্কোপ স্থাপন করছে। পানাজি মানমন্দির (Junta House)-এ সাধারণ দর্শকদের জন্য পর্যবেক্ষণ সেশন আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মারগাও, পরভোরিম, মাপুসা, এবং ভাস্কো শহরে নির্দিষ্ট তারিখে বিশেষ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এই পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন নেই। এই বিরল দৃশ্য সবচেয়ে ভালোভাবে রাত ৭:০০ থেকে ৮:৩০-এর মধ্যে দেখা যাবে।

ইতালির ভার্চুয়াল টেলিস্কোপ প্রোজেক্ট গ্রহসমূহের সারিবদ্ধতার একটি বিনামূল্যের ওয়েবকাস্ট করেছিল। মূলত ২৫ জানুয়ারি ভারতীয় সময় রাত ১১:০০টায় নির্ধারিত এই লাইভ স্ট্রিমটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিয়ানলুকা মাসি পরিচালনা করছিলেন, যেখানে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে ছয়টি গ্রহের সারিবদ্ধ অবস্থান দেখানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে, ঘন মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে লাইভ সম্প্রচারটি পুনঃনির্ধারিত হয়ে ২৬ জানুয়ারি রাত ১১:০০টায়  করা হয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, কেউ যদি মঙ্গল গ্রহে থাকে তাহলে সে কেমন ভাবে এই Planetary Parade দেখবে? উত্তর খুব সোজা, তিনি অবশ্যই এই parade দেখতে পাবেন কিন্তু যেহেতু তিনি আমাদের সৌর জগতের একটি আলাদা জায়গা থেকে দেখছেন, তাই গ্রহগুলির সারিবদ্ধতা আলাদাভাবে ধরা দেবে তার চোখে। বুধ, শুক্র, পৃথিবী যেহেতু সূর্যের কাছে, তাই তাদের কক্ষপথ অনুসারে দৃশ্যমানতা আলাদা হবে। আবার বাকি যে গ্রহগুলি যেমন, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, এগুলি মঙ্গলের আকাশে সম্পূর্ণ আলাদা অংশে দৃশ্যমান হবে।

Andrew McCarthy-এর এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত Planetary Parade এর একটি ছবি যেটি একটি ১১ ইঞ্চি টেলিস্কোপ-এর সাহায্যে তোলা।

ভারত থেকে এই Planetary Parade দেখতে হলে সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে তাকাতে হবে। এই বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চাইলে সঙ্গে রাখুন দুরবিন বা ছোট টেলিস্কোপ অথবা আপনার স্মার্টফোনে ডাউনলোড করে নিন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু অ্যাপ্লিকেশান যেমন Night Sky, Star Gazer, Sky Guide এবং আপনার ফোনটিকে আকাশের পশ্চিম দিকে তাক করে ধরে থাকুন। ২০২৫ সালের এই মহাজাগতিক বিস্ময় যদি কোন কারণে হাতছাড়া করেন তাহলে কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে আরও ৪০০ বছর!   

* লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand-র পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষক হিসেবে কর্মরত।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


AFC এশিয়ান কাপ ২০২৩: সুনীলদের Blue Tiger অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি

উত্তরাপথ: অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান এবং সিরিয়ার পাশাপাশি এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৩-এর বি গ্রুপে সুনীলদের Blue টাইগাররা। Blue টাইগাররা ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪-এ আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়ামে গ্রুপ পর্বের তাদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে।ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দল এএফসি এশিয়ান কাপ কাতার ২০২৩-এ ১৩ জানুয়ারি আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে গ্রুপ বি-তে প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে। এশিয়ার শীর্ষ ২৪ টি দল দোহার কাটরা অপেরা হাউসে তাদের গ্রুপ পর্বে অংশ গ্রহণ করেছে। এএফসি এশিয়ান কাপ কাতার ১২ জানুয়ারী .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়

এ যেন বহুদিন পর বিজেপির চেনা ছন্দের পতন। হিমাচল প্রদেশের পর কর্ণাটক কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির বিজয়রথকে থামিয়ে দিল ।২০১৮ পর থেকে লাগাতার হারতে থাকা একটি দল আবার ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনে প্রাসঙ্গিক হয়ে গেল । ২২৪ সদস্যের কর্ণাটক বিধানসভায় সরকার গঠন করতে গেলে প্রয়োজন ১১৩টি আসন সেখানে কংগ্রেস একাই পেয়েছে ১৩৬টি আসন, বিজেপি পেয়েছে ৬৫ টি এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার জেডিএস পেয়েছে ১৯টি এবং অন্যান্য ৪ টি আসন পেয়েছে। যা গতবারের তুলনায় বিজেপির ৩৯ টি আসন কমেছে এবং কংগ্রেসের বেড়েছে ৫৭টি আসন এবং জেডিএসের কমেছে ১৮ টি আসন।   কর্ণাটকে কংগ্রেসের এই সাফল্য কি রাজ্যে কংগ্রেসের শক্তিশালী সংগঠনের ফল না কি কর্ণাটকের আগের ক্ষমতাশীল বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ । কর্ণাটকে কংগ্রেসে অনেক বড় নেতা রয়েছে।  প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শিবকুমার দক্ষ সংগঠক। আগের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়ার ব্যাপক জনভিত্তি রয়েছে।  ভোটের আগে বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার এবং উপমুখ্যমন্ত্রী সাভাড়ি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে নির্বাচনে লড়েছেন। অন্যদিকে বিজেপির প্রচারের সবচেয়ে বড় মুখ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিজেপির প্রচারে সব নেতারাই মোদীর নাম করেই ভোট চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হল না ।কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি সেই সাথে কংগ্রেসের লাগাতার প্রচার যা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুরকে আরও তীব্র করেছে। তাই শুধুমাত্র মোদী ম্যাজিকের উপর ভর করে নির্বাচন জেতা যে  আর বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয় কর্ণাটকের জনগণ চোখে হাত দিয়ে তাই দেখিয়ে দিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রবীর ঘোষও আমি

ড. জীবনকুমার সরকার: ৭ এপ্রিল ২০২৩ প্রয়াত হলেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রবীর ঘোষ। তাঁর প্রয়াণে দেশ ভারাক্রান্ত। যুক্তিবাদীরা চরম মর্মাহত। আমিও। তাঁর সঙ্গে কীভাবে জড়িয়েছিলাম সে এক ইতিহাস। ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক পাস করে গাজোল হাইস্কুলে সবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। নতুন বইয়ের মধ্যে ডুবে আছি। আর নিয়মিত ক্লাস করছি। এইভাবে পুজোর ছুটি এসে যায়। পুজোর ছুটির আগের দিন অর্থাৎ যেদিন স্কুল হয়ে এক মাসের জন্য বন্ধ থাকবে স্কুল, সেইদিন আমি আর রাজেন লাইব্রেরীতে যাই। রাজেন আমার ছাত্রজীবনের সেরা বন্ধু। দুজনে কী বই নেবো, কী ধরনের বই নিয়ে .....বিস্তারিত পড়ুন

কার্বন নিঃসরণ দ্রুত শেষ করার জন্য G7 ঐক্যমত

উত্তরাপথ: বিশ্বের সাতটি ধনী দেশের শক্তি ও পরিবেশ মন্ত্রীরা সম্প্রতি  জ্বালানি এবং পরিবেশগত ইস্যুতে উত্তর জাপানের শহর সাপোরোতে বৈঠক করেন।  G-7 বৈঠকে জড়ো হওয়া বিভিন্ন দেশের আধিকারিকরা তাদের প্রতিশ্রুতির রূপরেখা দিয়ে একটি কমিউনিক জারি করেছে। বৈঠকে বর্তমান সঞ্চিত জ্বালানি সংকট এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমান গুরুত্ব দিয়ে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG) নির্গমনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সমস্ত নেতারা দক্ষ, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং দূষণ মুক্ত শক্তির উৎস সন্ধানের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগেও .....বিস্তারিত পড়ুন