



গার্গী আগরওয়ালা মাহাতোঃ উষ্ণায়ন কি সত্যি আমাদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে ? আগাম সতর্কতা হিসাবে বলা হচ্ছে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০০০ সালের তুলনায় প্রায় এক ফুট বেশি হবে। আজকে যে মানুষের বয়স ৩১ বছর এবং তারা ৭৩.৫ বছর ধরে বেঁচে থাকার আশা করতে পারেন, আবার আমাদের অনেকেই হয়তো পরবর্তীতে এর পূর্ণ প্রভাব দেখতে বাঁচবেন না, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই আমাদের ক্ষতি করতে শুরু করছে।


কেউ কেউ বলতে পারেন যে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আজ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সত্য হলো, জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই আমাদের দৈনন্দিন জীব্নের মানকে প্রভাবিত করছে: আমাদের মেজাজ, আয়, এমনকি আমাদের বাচ্চাদের স্কুলের পারফরম্যান্সকেও। কল্পনা করুন রাজস্থানের একটি ছোট গ্রামের প্রিয়া নামে এক তরুণী থাকে । সে স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার পর বড় শহরে চলে যাবে এবং তার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করবে। কিন্তু তার গ্রামের প্রচণ্ড রোদ তাদের মাঠ ,জলাশয় সব শুকিয়ে দিচ্ছে , তার পরিবারের চাষের ফসল নষ্ট করছে , এবং তার শিক্ষার টাকা মরুভূমির জলের মতো চলে যাচ্ছে। এটি কেবল প্রিয়ার গল্প নয় – এটি ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের গল্প, যেখানে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মানুষের জন্য সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কঠিন করে তুলছে।
ভারত তাপের সাথে অপরিচিত নয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তন তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হচ্ছে , বর্ষাকাল অপ্রত্যাশিত হচ্ছে এবং খরার সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। প্রিয়ার মতো পরিবারগুলির যারা কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল, তাদের রোজগার কমছে । যখন ফসল নষ্ট হয়, তখন বাবা-মা স্কুলের ফি বা বই এর খরচ বহন করতে পারেন না। প্রিয়ার মতো শিশুদের প্রায়ই স্কুল ছেড়ে দিতে হয় এবং তাদের পরিবারকে টিকে থাকতে সাহায্য করার জন্য কাজ করতে হয়। উন্নত জীবনের স্বপ্ন—উন্নত শিক্ষা, উন্নত চাকরি, উন্নত ঘর—নাগালের বাইরে চলে যায়।
শুধু গ্রাম নয়। শহরেও, তাপ জীবনকে কঠিন করে তুলছে। মুম্বাইয়ের কথা ধরুন, যেখানে ফুটপাথের বাসিন্দা এবং বস্তিবাসীরা তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে। ফ্যান বা কুলার ছাড়া, রাস্তার বিক্রেতা বা নির্মাণ শ্রমিকদের মতো শ্রমিকরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে তীব্র লড়াই করছে। তাপপ্রবাহ তাদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে, সেই সাথে তাদের আয় । তাদের বাচ্চাদের জন্য, টিনের চালার একটি ছোট ঘরে পড়াশোনা করা একটি যুদ্ধ। যখন তীব্র গরমের সাথে লড়াই করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ ,সেখানে একটি শিশুর পক্ষে পড়াশুনাতে মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন ব্যাপার।
অন্যদিকে যারা ভালো চাকরি করেন – শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে কাজ করেন – তারা আরও ধনী হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে গরম আবহাওয়ায়, ভারতের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা আরামদায়ক তাপমাত্রার উপরে প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াসে ২-৪% হ্রাস করছে। যখন কর্মক্ষেত্রে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়, তখন তাদের উৎপাদন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। এর অর্থ হল, ইট বা কাপড় তৈরির শ্রমিকরা কম আয় করতে প্রায় বাধ্য হচ্ছে , কারণ তারা খুব বেশি গরমে ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন না। তারা কেবল তাদের কাজ বন্ধ করতে পারছেন না; তবে তাদের সাধ্যের মধ্যে তারা যতটা করতে পারছেন তাই করছেন, কিন্তু এটি তাদের আয় এবং এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তাপ শিশুদের শিক্ষারও ক্ষতি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে নিউ ইয়র্ক সিটিতে, গরমের দিনে পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ পয়েন্ট কম স্কোর করেছে। গরম আবহাওয়া দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য – যারা প্রায়শই জনাকীর্ণ, দুর্বল বায়ুচলাচল বাড়িতে বাস করে – পড়াশোনা করা এবং স্কুলে ভালো ফল করা আরও কঠিন করে তুলছে। এটি প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষদের সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে ওঠা আরও কঠিন করে তুলছে ।বৃহত্তর পরিসরে, গরম দেশগুলির আয় কম থাকে। তাপমাত্রার প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির সাথে সাথে, একটি দেশের গড় আয় প্রায় ৮% কমে যেতে পারে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও, গরম স্থানগুলিতে দরিদ্রের হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
তাপ কেবল কাজ এবং স্কুল জীবনকেই প্রভাবিত করে না। এটি ভুল এবং দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি করে। টেনিস ম্যাচের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, গরমের দিনে খেলোয়াড়রা ৭% বেশি ভুল করে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাপ মানুষের আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে—মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন,এর জেরে ট্রাফিক লাইটে তাড়াতাড়ি হর্ন বাজাতে শুরু করে। এছাড়াও গরম আবহাওয়ায় ধর্ষণ ও হত্যার মতো সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
এই সবকিছুই দেখায় যে উষ্ণতা বৃদ্ধি কেবল সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি বা হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে নয়। এটি ইতিমধ্যেই আমাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে, বিশেষ করে প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষদের। ভবিষ্যতে আরও খারাপ সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও পড়ুন
NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে
উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি
উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন