সারা বিশ্বে ক্ষুধা এবং অপুষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান নিরাশাজনক। দায় কার?

উত্তরাপথঃ ১.৩ বিলিয়ন জনসংখ্যা এবং একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সহ ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। একটি গণতান্ত্রিক জাতি হিসাবে সারা বিশ্বে মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও, ক্ষুধা এবং অপুষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান নিরাশাজনক।২০২৩ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুসারে, ভারত বিশ্বের ১২৫টি দেশের তালিকায় ১১১ তম স্থানে রয়েছে, যা দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির গুরুতর অবস্থা নির্দেশ করে।এ ক্ষেত্রে দেশের অবস্থা কতটা খারাপ তা অনুমান করা যায় ভারত তার প্রতিবেশী দেশ যেমন বাংলাদেশ (৮১), পাকিস্তান (১০২), নেপাল (৬৯), শ্রীলঙ্কা (৬০) থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই সূচকে ভারতকে মোট ২৮.৭ পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতির গুরুতরতা দেখানোর জন্য যথেষ্ট।প্রসঙ্গত ২০২২ সালে, ভারত এই সূচকে ১০৭ তম স্থানে ছিল। এর মানে ২০২২ সালের তুলনায় দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, যার কারণে তা চার ধাপ কমে ১১১-এ দাঁড়িয়েছে। তবে এই তালিকায় মোজাম্বিক, আফগানিস্তান, চাদ এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের উপরে রাখা হয়েছে ভারতকে। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে অপুষ্টির হার ৪৮.৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে অপুষ্টির পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। শিশুদের মধ্যে এই অপুষ্টির হার ১৮.৭ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। একইভাবে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার প্রাদুর্ভাব ৫৮.১ শতাংশ । মানে এই বয়সী নারীদের অর্ধেকেরও বেশি রক্তশূন্যতার শিকার।শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬.৬ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। একই সময়ে, পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৫.৫ শতাংশ শিশু স্টান্টড অর্থাৎ তারা তাদের বয়সের তুলনায় ছোট। একইভাবে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার রেকর্ড করা হয়েছে ৩.১ শতাংশ। কিছুটা হলেও, এই পরিসংখ্যানগুলি দেশে বিরাজমান অপুষ্টির গুরুতর পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে, যা উপেক্ষা করা যায় না।

যদিও ভারত সরকার গত দুই বছর ধরে এই প্রতিবেদনকে অস্বীকার করে আসছে। সরকারের মতে, এই প্রতিবেদনে যে পরিমাপ বা ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে । কিন্তু সরকার যাই বলুক না কেন, এই প্রতিবেদনে থাকা পরিসংখ্যানকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না এবং এটি দেশে অপুষ্টির একটি অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করছে সন্দেহ নেই।যেখানে আর হাতেগোনা কয়েকদিন পর ১৮ তম লোকসভা নির্বাচনের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি সেখানে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা সমাধানে ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা উদ্বেগের বিষয়। ক্ষুধা দূরীকরণের লক্ষ্যে অসংখ্য সরকারি স্কিম এবং কর্মসূচির উপস্থিতি সত্ত্বেও, ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এই সমস্যার মূলে রয়েছে এসব কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব,সে সাথে সরকারের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা।যার দায় কি কেন্দ্র কি রাজ্য উভয় সরকারের, কোনও সরকারই এর দায় এড়াতে পারেনা।  

ক্ষুধা এবং অপুষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের হতাশাজনক অবস্থানের অন্যতম প্রধান কারণ হল সম্পদ এবং সুযোগের অসম বন্টন। যখন দেশের কিছু অংশ উন্নতি লাভ করছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনুভব করছে, তখন দেশের একটা বড় অংশ দারিদ্র্য,বেকারত্ব, খাদ্য ও বিশুদ্ধ জলের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে জর্জরিত। উন্নয়নে এই বৈষম্য ক্ষুধার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে, কারণ আমাদের বিশাল সংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ে আছে। তাদের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। যার ফলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্বল স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল পরিকাঠামো এবং অপর্যাপ্ত খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার মতো কারণগুলির জন্য এই সমস্যাটি আরও জটিল হচ্ছে।

এটা লক্ষণীয় যে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স হল দেশ ও বিশ্বের ক্ষুধা ও অপুষ্টি পরিমাপ ও ট্র্যাক করার একটি হাতিয়ার। আমরা যদি বৈশ্বিক স্তরের দিকে তাকাই, সূচক অনুযায়ী, নয়টি দেশে ক্ষুধা ও অনাহার পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক, এর মধ্যে রয়েছে বুরুন্ডি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, লেসোথো, মাদাগাস্কার, নাইজার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেন। ভারত সহ আরও ৩৪টি দেশের পরিস্থিতিও গুরুতর।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক বিপর্যয় ঘটেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। প্রথমে মহামারী, তারপর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত চরম আবহাওয়া বিপর্যয় মানুষের কোমর ভেঙে দিয়েছে। যদিও এই দুর্যোগগুলি কৃষিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, এবং প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও বাড়িয়েছে।

কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চ ক্ষুধা সূচক দেশের ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা একটি বড় কারণ যার দায় অবশ্যয় সরকারের।দেশের সব সব নাগরিকের পুষ্টিকর খাবারের যোগান দেওয়া এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা সরকারের সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির  প্রধান কাজ। কিন্তু সরকারি ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমাদের কৃষকদের মনোবল কমেনি। এই বিষয়ে, ২৮ বছর বয়সী পুরুলিয়ার গঙ্গারাম সর্দার,যিনি পেশায় একজন কৃষক, বলেন, “আমাদের বাবা-মা কৃষক, আমাদের পূর্বপুরুষরাও কৃষক ছিলেন এবং আমরা ছোট কৃষকদের সামনের সমস্যাগুলি বুঝি। আমরা যদি আমাদের সমস্যার সমাধান না করি, কে করবে?

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


রাজা মহম্মদ ও সি সেল মিউজিয়াম

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ রাজা মহম্মদ, এমন একজন মানুষের নাম, যার ব্যাক্তিগত ইচ্ছার কাছে হেরে যায় সব বাধা। ইচ্ছার চেয়ে বলা ভালো নেশা। সামুদ্রিক প্রাণীদের খোল সংগ্রহের নেশা। যা তাঁকে ছোটবেলা থেকেই ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে প্রায় তিরিশ বছর ধরে। আর সেই দীর্ঘ পথের শেষে , তিনি সম্পূর্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এশিয়ার বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাক্তিগত সংগ্রহশালা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সি সেল মিউজিয়ামটি বর্তমানে চেন্নাইয়ের মহাবলিপূরম মন্দিরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। রাজা মহম্মদ ছোট্ট বেলা থেকেই  সমুদ্র তট থেকে সংগ্রহ করতেন বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাংশ। কুড্ডালোর থেকে রামেশ্বরম এর সমুদ্রতট, সেখান থেকে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশে গিয়েছেন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে। সংগ্রহ করেছেন অসাধারণ সব সামুদ্রিক .....বিস্তারিত পড়ুন

তিব্বতে ওজোন স্তরের গর্ত গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে

উত্তরাপথঃ ওজোন স্তর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি অপরিহার্য দিক, যা স্ট্রাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত। এটি সূর্য দ্বারা নির্গত ক্ষতিকারক অতিবেগুনী (UV) বিকিরণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওজোন স্তরের অবক্ষয় , বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর ধরনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে । এরকম একটি পরিণতি হল তিব্বতে ওজোন স্তরের গর্ত যা সেখানকার গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে।তিব্বতকে, প্রায়শই "বিশ্বের ছাদ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়।এটি একটি বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র এবং অনন্য আবহাওয়ার নিদর্শন সহ এক বিশাল অঞ্চল। এর বিশাল এলাকা জুড়ে উচ্চ পর্বতমালা, মালভূমি এবং গভীর উপত্যকা রয়েছে । .....বিস্তারিত পড়ুন

একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) স্পেন সফরে

উত্তরাপথঃ  একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পেনে রয়েছেন। জানা যাচ্ছে, স্পেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বৈঠক হবে ফুটবল নিয়ে। ১৪ সেপ্টেম্বর, মাদ্রিদে লা লিগার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদলের বৈঠক। বাংলা ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে সরকারের সঙ্গে কোনও বিশেষ চুক্তি হতে পারে লা লিগার । এই বৈঠকে তাঁর সঙ্গে থাকবেন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিংয়ের ক্লাবকর্তারাও। এছাড়াও থাকার কথা  সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও।যদিও তিনি এই মুহূর্তে লন্ডনে রয়েছেন লন্ডনে,সেখান থেকেই ১৪ তারিখ সরাসরি মাদ্রিদ পৌঁছবেন বলে খবর।এরপর স্পেনে মমতার লক্ষ্য রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ টানা। রাজ্যে বিদেশি লগ্নি বাড়াতে তিনি সঙ্গে বড় প্রতিনিধিদল নিয়ে স্পেনে গিয়েছেন।প্রতিনিধিদলে রয়েছেন ময়দানের তিন ফুটবল ক্লাবের কর্তা, বই প্রকাশকদের একটি দল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top