ড্রিমসিটি

অনসূয়া পাঠক

শরতের সোনাঝরা সকাল ভরে উঠেছে শিউলীর মৃদু গন্ধে , নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা …. ঘড়ির কাঁটায় ৬.৩০ ।  ঋতু র ঘুম ভাঙতেই চোখ চলে যায় পাশে বেড টেবিলের উপর সযত্নে নামানো বাদামী রঙের ধাতব আইফেল টাওয়ারের দিকে ।

 এই আইফেল টাওয়ারের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঋতুর এক অদ্ভুত রহস্যময় অভিজ্ঞতা র গল্প । বেশ কিছু বছর আগের কথা মা বাবা র সাথে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলো ঋতু । ছোটবেলা থেকেই ঋতু খুব ভ্রমনপিপাসু। সারা পৃথিবী  সে ঘুরবে  , এই স্বপ্ন বুকের মধ্যে জমানো। তবে যে জায়গা টা সবচেয়ে বেশী টানে তাকে সেটা হলো ফ্রান্সের স্বপ্নের শহর , “দি সিটি অফ লাভ” প্যারিস ।  ঋতুর কাছে প্যারিস মানে একদিকে গোটা বিশ্বের সব দর্শনীয় স্থান , আর একদিকে একা প্যারিস । ইচ্ছে টা দারুণ হলেও সাধারণ মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের একজন মেয়ের জন্য এটা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে । তবুও তার দৃঢ় বিশ্বাস জীবনের কখনো কোনো দিন তার এই স্বপ্ন নিশ্চই  পূরণ হবে । 

দার্জিলিং এর ঘুম স্টেশনে নেমে ঋতু রা ট্যাক্সি করে হোটেল সানভিউ তে পৌঁছায়। বেশ কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ফ্রেস হয়ে কফি স্ন্যাকস খেয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নেমে আসা দার্জিলিং এর বিখ্যাত ড্রাগন মার্কেট দেখতে বেরিয়ে পড়ে । দুপাশে সাজানো পশমের বাজার । রামধনু র মতো উলের পশরা । কোন কোন দোকানে সাজানো নানা রঙের ড্রিম ক্যাচার । এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎই ঋতুর চোখ পড়লো একটা সবুজ রঙের বড়ো কাঠের বাক্সের উপর।সেটা আসলে কি তা  ভালো করে দেখার জন্য ঋতু বাক্সের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ।  ঋতু দেখে বাক্সের কাছে ছোট্ট একটা টুলে গলায় লাল মাফলার মাথায় লাল টুপি পরে একটি বেঁটে মোটা লোক  বসে আছে। তার হাতে একটা বোর্ড তাতে নীল কালিতে লেখা ” দি উইস মেকারস শপ”….  ঋতু লোকটি র কাছে দাঁড়াতেই লোকটি মাথা ঝুঁকে বলে ওঠে , হ্যলো প্রিন্সেস , আই আ্যাম মিষ্টার জি….  ঋতু নমস্কার করে বলে , আমি ঋতু , ফ্রম বাঁকুড়া … আচ্ছা এই বাক্সটা কিসের ?   মিষ্টার জি বলে ওঠে , শোনো ঋতু সত্যিই যদি মনের ভেতরে তোমার কোন স্বপ্ন থেকে থাকে ,তা এখানের গোলাপি কাগজে লিখে এই বাক্সের ভেতরে ফেলে দিলে তা সত্যি হয়ে যায়। মিষ্টার জি র কথা শুনে ঋতুর বিশ্বাস হলো এই বাক্সের ভেতরে তার মনের কথা লেখা গোলাপি কাগজটা ফেলে দিলে তার ও স্বপ্ন পূরণ হবে । প্যারিস ভ্রমনের ইচ্ছে টা লিখে বাক্সে ফেলে দিলো ঋতু ….  হোটেলে ফিরে ডিনার সেরে নরম বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলো ঋতু । গোটা দিনের ক্লান্তি র মাঝে সন্ধ্যার ওই স্বপ্ন পূরণের ব্যাপার টা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।

কিছু ক্ষণ পর হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গেলো , এবং চোখ খুলে সে দেখে , কি আশ্চর্য ঋতু হোটেলের বিছানায় নেই , সে একটা প্লেনের সিটে জার্ণি করছে ।  গোটা প্লেনে আর কেও নেই । ঋতু ভাবে সে কি স্বপ্ন দেখছে ? হঠাৎই শুনতে পায় মিস্টার জি র গলার আওয়াজ , প্রিন্সেস এটা স্বপ্ন নয় , আমরা তোমাকে তোমার স্বপ্নের শহর প্যারিস নিয়ে যাচ্ছি। ঋতু চমকে ওঠে , একি শুনছে সে , বিশ্বাস করতে পারছে না । আমতা আমতা করে বলে , প্যারিস কিন্তু কেন ? তার কথা শুনে মিষ্টার জি বলে ওঠে , তুমি উইসমেকারের দোকানে প্যারিস যাওয়ার কথা বলেছিলে। ঋতু বলে ,হ্যাঁ সেতো বলেছিলাম , কিন্তু আরও অনেকেই অনেক কিছু বলছিলো , তাদের ও কি ইচ্ছে পূরণ হবে ? মিস্টার জি মুচকি হেসে বললেন , না প্রিন্সেস , ইচ্ছে পূরণ তাদের ই হবে যাদের নিজের ইচ্ছে র উপর পুরো বিশ্বাস আছে । সরল সত্য মন নিয়ে গোলাপি কাগজে যে লেখে।

ঋতু র তবুও যেনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না । এর ই মধ্যে তাদের প্লেন প্যারিস এয়ারপোর্ট এ পৌঁছায় । ঋতু ও মিস্টার জি এয়ারপোর্টে র বাইরে এসে একটা সাদা ওপেন রুফ গাড়িতে বসলো । সত্যিই ঋতু অবাক , তার চোখের সামনে আলোয় ভাসছে তার ড্রিম সিটি  প্যারিস । যে শহরকে সে বারবার ছবিতে দেখেছে , সেই প্যারিসের মাটিতে দাঁড়িয়ে মনের মধ্যে খুশী ও কৌতুহলের এক মিশ্র অনুভূতি র  অপার্থিব আনন্দ অনুভব করলো ঋতু।

প্যারিসের সেই ফেমাস রাজপ্রাসাদ যাকে একাই একটা শহর বলা হয় , লাভরি মিউজিয়াম যার মধ্যে লিউনার্দো দ্যা ভিঞ্চি র অবিস্মরণীয় সৃষ্টি মোনালিসা সযত্নে রক্ষিত …..  এ সব কিছু দেখে তারা গিয়ে দাঁড়ালো প্যারিসের পৃথিবী বিখ্যাত আইফৈল টাওয়ার এর সামনে, খুশিতে উচ্ছল ঋতু।  মার্চি ডি আ্যালিগরি বাজারে দেখে একটি  দোকানে কাঁচের শো কেসের ভেতরে আইফেল টাওয়ারের মডেল একটা ছোট্ট বাদামী রঙের আইফেল টাওয়ার সাজানো রয়েছে। সেটাকে দেখে ঋতুর নেবার ভীষণ ইচ্ছে হলো । মিস্টার জি ঋতু কে বললো , প্রিন্সেস তুমি এটা নিতে পারো । ঋতু বললো , কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই। মিষ্টার জি বললো , ওটা কোন ব্যাপার নয় , আমার তরফ থেকে এটা তোমাকে গিফ্ট প্রিন্সেস। এরপর প্যারিসের ফেমাস হোটেল লুটিটিয়া তে তারা ঢোকে । যেখানে একদিনে থাকার বিল ভারতীয় মুদ্রা য় প্রায় একানব্বই  হাজার টাকা।

হোটেলের ব্যালকনি থেকে রঙীন আলোয় মোড়া প্যারিস শহরটাকে স্বপ্নের যাদু নগরী সুন্দর  স্বর্ণপুরীর মতো মনে হচ্ছে। প্যারিসে র  হট ফেভারিট মেকরোণি খেয়ে  ধপধপে সাদা বিছানায় শুয়ে পড়ে ঋতু ।

হঠাৎ ই ঋতু শোনে তার মা এর ডাক , ওঠ্ ঋতু , টাইগার হিল সানরাইজ দেখতে যেতে হবে , আর কতো ঘুমোবি ? উঠে পড় সোনা।  ঘুম ভেঙে যায় ঋতুর। একি সে তো তার দার্জিলিং এর সানভিউ হোটেলের বিছানায় । তাহলে এতোক্ষন যা দেখলো সে সব ই কি স্বপ্ন ? ভাবতে ভাবতেই দেখে তার বিছানার পাশে নামানো বাদামী রঙের ধাতব আইফেল টাওয়ার ….. চমকে ওঠে ঋতু। কি হচ্ছে এসব তার সাথে ? সব কি শুধুই স্বপ্ন না সত্যি । একটা ঘোরে র মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ঋতু । ব্রেকফাস্ট টেবিলে  রাতের সব কথা সে তার বাবা মা কে বলে ।  তার মা বলে , এসব নিয়ে বেশী ভাবিস না তো । তুই স্বপ্ন দেখে কি সব ভূলভাল বলছিস । ঋতু র বাবা বলে ছাড় এসব চল আর একবার বাজারে গিয়ে কেনাকাটা টা সেরে ফেলি ।  সেই বাজারে গিয়ে  ঋতু দেখে যেখানে আগের দিন উইশমেকারের শপ ছিলো সেখানে গিয়ে দেখে একটি  ছোট্ট পাথরের নীচে একটি গোলাপি কাগজ চাপা দেওয়া। ঋতু পাথরটি সরিয়ে গোলাপি কাগজটি হাতে নিয়ে দেখে , তার উপর লেখা রয়েছে , কনগ্রাচুলেশনস প্রিন্সেস ফর ইওয় ড্রিম কাম ট্রু , শেষে ডানদিকে রয়েছে মিস্টার জি ও ডি …. মিস্টার জি ফুল নেম মিস্টার গড ….

ওঃ মাই গড , চমকে ওঠে ঋতু। ঈশ্বরের দেওয়া সেই আইফেল টাওয়ার ঋতুর বেড টেবিলে সযত্নে সাজানো ।

অনেকদিন পর ও দিনের শুরুতে আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে সেই রাতটা র কথাই ভাবে ঋতু । হাজার ভেবেও এর মধ্যে কোন লজিক খুঁজে পায়না ঋতু । কিন্তু আসলে একটা কথা আছে না , ” যখন ভগবানের মর্জি হয় তখন কোন লজিক হয় না , শুধু ম্যাজিক হয় “।।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


টাইপ 2 ডায়াবেটিসে সময়ে খাবার খাওয়া, ক্যালোরি গণনার চেয়ে বেশি কার্যকর

উত্তরাপথঃ টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষ্য হল ওজন কমানো , অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার সাথে টাইপ 2 ডায়াবেটিসের অবস্থার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।এই বিপাকীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কোন ডায়েটিং কৌশলটি সবচেয়ে ভাল কাজ করে তা স্পষ্ট নয়।েতবে টাইপ 2 ডায়াবেটিস রোগীদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে অধ্যয়নের অংশগ্রহণকারীরা যারা দুপুর থেকে রাত ৮ টার মধ্যে খাবার খাওয়া শেষ করেছে তারা, যারা ক্যালোরি গণনা করে তাদের সামগ্রিক ক্যালোরি গ্রহণ কমিয়েছেন তাদের .....বিস্তারিত পড়ুন

জানুন ২০২৩ সালের জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক ডঃ শীলা অসোপা'র কথা

ত্তরাপথঃ ডঃ শীলা অসোপা, সরকারি বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্যাম সদন, যোধপুরের অধ্যক্ষা, তিনি ১৭ বছর ধরে স্কুলের বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন।তাঁকে শিশুদের শেখানোর নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, স্কুলের অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং উদ্ভাবনের জন্য ২০২৩ সালের জাতীয় শিক্ষক পুরস্কারে পুরুস্কৃত করা হয়।  ডঃ অসোপাকে, যোধপুরে শ্যাম সদন, সরকারি বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, ১০ মাস আগে বদলি করা হয় । সেই সময় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ে মাত্র দুটি কক্ষ ছিল।মেয়েরা টিনের চালা দিয়ে তৈরি ঘরে পড়াশোনা করত।  ঘর কম থাকায় গাছের নিচেও ক্লাস হত । তার কথায় ,সেই সময়টা বাচ্চাদের পড়াশুনা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় কেটেছে । এরপর টিনের চালা দিয়ে তৈরি কক্ষে কাঠের পার্টিশন দিয়ে ৬টি কক্ষ তৈরি করা হয়। .....বিস্তারিত পড়ুন

এবার চাঁদের পথে জাপান, অবতরণে সময় লাগতে পারে ছয় মাস

উত্তরাপথঃ এ যেন হঠাৎ করে শুরু হওয়া বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।ভারতের পর এবার চাঁদের পথে পারি দিল জাপান । চাঁদের জন্য SLIM নামে  তাদের নিজস্ব মুন ল্যান্ডার উৎক্ষেপণ করেছে জাপান।  মহাকাশযানটি ৭ সেপ্টেম্বর জাপানের স্থানীয় সময় সকাল ৮.৪২মিনিটে উৎক্ষেপণ করা হয়।  এটিতে জাপানের নিজস্ব  H2A রকেট ব্যবহার করা হয়েছে। এই মহাকাশ যানটি  তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।প্রসঙ্গত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে জাপান এটিকে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ১০ দিন দেরিতে উৎক্ষেপণ করল।মহাকাশযান SLIM ছাড়াও একটি মহাকাশ টেলিস্কোপও পাঠিয়েছে জাপান।উভয় মহাকাশযান এক ঘন্টার মধ্যে তাদের নির্দিষ্ট পথে পৌঁছেছে।  সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে 'স্মার্ট ল্যান্ডার ফর ইনভেস্টিগেটিং মুন' (SLIM) প্রায় চার মাস পর চাঁদে অবতরণ করবে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top