বই মেলার কথা 

 প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ তো এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। সেই চোদ্দতম পার্বণ হল বাঙালির বই মেলা বা ভালো কথায় ‘কলকাতা আন্তর্জতিক বই মেলা’। এই ডট কমের যুগেও মানুষ কীভাবে পাঁচশ বছর পুরনো গুটেনবার্গের আবিষ্কারকেই মনে প্রাণে ভালোবেসে  চলেছে তার প্রমাণ পেতে গেলে ঘাঁটতে হবে বই মেলার ইতিহাস। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর এশিয়ার বৃহত্তম এই অবাণিজ্যিক মেলা সত্যিই বাঙালির গর্বের বিষয়।

পৃথিবীর প্রথম বই মেলা আর গুটেনবার্গ এর ছাপাখানা আবিষ্কার একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর ছিল ইউরোপের অন্যতম ব্যাবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। তো তার থেকে কিছু দূরেই মেঞ্জ শহরে গুটেনবার্গ আবিষ্কার করে বসলেন তাঁর প্রথম বই ছাপার মেশিন। আর তাতে কয়েকটি বই ছেপে তিনি তার প্রচারের উদ্দেশ্য উপস্থিত হলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। তাঁর দেখা দেখি আরও কয়েকজন উপস্থিত হলেন তাঁদের প্রকাশিত বই নিয়ে। ব্যাস আর কী? এভাবেই ধীরে ধীরে জমে উঠলো বই কেনা বেচার আসর আর সম্ভবত ১৪৬২ বা মতান্তরে ১৪৭৮ সাল থেকে তা রূপ নিলো প্রথম বই মেলার। শোনা যায় অষ্টম হেনরিও নাকি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গ্রন্থাগারে বই সংগ্রহের জন্য এখানে তাঁর প্রতিনিধি পাঠান। ১৯৪৯ এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি। সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পরে এর সুনাম। বই ও প্রকাশক সংস্থাগুলোর এমন বাণিজ্যিক প্রদর্শনীতে ভিড় জমাতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। চলত হাজার হাজার টাকার কেনা বেচা। ১৯৬৪ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলা পায় বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এখনও অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পাঁচ দিন ধরে চলে এই মেলা। অংশ নেয় একশটিরও বেশি দেশ।

ভারতের আন্তর্জাতিক বই মেলার সঙ্গেও এই গল্পের যোগাযোগ আছে বৈকি। আরে বাবা, বাঙালির সাহিত্যপ্রেমী স্বত্বা তো সর্বজনবিদিত।  ব্রিটিশ আমলে যখন সারা দেশে স্বদেশিকতার জোয়ার এসেছে, কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ তখন বৌবাজারে ( ভিন্ন মতে কলেজ স্ট্রিট) আয়োজন করলো দেশীয় পুস্তক প্রদর্শনীর। তাতে যেমন যোগ দেয় বিভিন্ন নামি দামি প্রকাশক তেমনি অংশ নেন বাংলার বিশিষ্টজনরা। নীলরতন সরকার, বিপিন চন্দ্র পাল, শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এনাদের সঙ্গে আরও স্বাধীনতা সংগ্রামী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এই পুস্তক প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে। ধীরে ধীরে সাহিত্য প্রেমী বাঙালির মনে এই পুস্তক প্রদর্শনীর জন্য উদ্যোগ ও আবেগ দুইই বাড়তে থাকে। স্বাধীন ভারতবর্ষে মননশীল বাঙালির চিন্তাশীলতার পীঠস্থান কফি হাউস এ বসে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রকাশক গণ মিলে বাঙালির এই ভাবধারার মর্যাদা দিতে ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলার আদলে একটি বই মেলার আয়োজন করার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স অ্যাসোসিয়েশন ১৯৭৬ সালের ৫ ই মার্চ কলকাতায় বর্তমানে মোহর কুঞ্জ উদ্যানে উদ্বোধন হয় প্রথম বই মেলার। ইউ এন ধর এন্ড সন্স এর কর্ণধার বিমল ধর ও অন্যান্য অনেকে এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ৩৪ টি প্রকাশনী ও ৫০ টি স্টল নিয়ে প্রথম মেলার উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজ্যপাল এ এল ডায়াস । প্রবেশ দ্বারের নকশা তৈরি করেন বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। ৫০ পয়সা প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে কলকাতার বুকে যে বই মেলার পথ চলা শুরু ,পরিসর ও কলেবরে তা আজ সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। ২০২৫ এ তা পা দিলো ৪৬ তম বর্ষে।

এই এতোগুলো বছরে একে একে যেমন অনেক নতুন পালক জুড়েছে বইমেলার মুকুটে তেমনি তাকে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা বিপত্তি। ১৯৮৩ সালে এই বইমেলা পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৯১ সাল থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলার আদলে এখানেও থিম এর প্রচলন শুরু হয়। প্রথম থিম ছিল অসম রাজ্য। ১৯৯৭ সাল থেকে কোনও একটি বিদেশী রাষ্ট্র কে ‘ফোকাল থিম’ ও অপর একটি রাষ্ট্রকে সম্মানীয় অতিথি হিসাবে দ্বিতীয় ফোকাল থিম নির্বাচিত করা হয়। এর আসল উদ্দেশ্য বিভিন্ন রাজ্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করা। দেশের প্রায় সবকটি স্বীকৃত ভাষা ও নানান বিদেশী ভাষার বই পাওয়া যায় এখানে। আসে দেশী বিদেশী হাজার হাজার প্রকাশক সংস্থা, বসে অসংখ্য স্টল, সামিল হন রাজ্য, দেশ ও পৃথিবীর অগণিত মানুষ, বসে আলোচনা সভা। সব থেকে বড় পাওনা পাঠক ও লেখক লেখিকার সম্মুখ সাক্ষাৎকার। এ সব নিয়ে বইমেলার কয়েকদিন কলকাতা হয়ে ওঠে পৃথিবীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র বিন্দু।

যদিও ১৯৯৭ সালের বিভৎস অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বইমেলার একাংশ। ২০০৭ সালে পরিবেশ সংক্রান্ত এক মামলায় পরিবর্তিত হয় এর অবস্থান। ২০০৮ এ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে বইমেলার উদ্বোধন। শত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কলকাতা বইমেলা আজও তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি নিয়ে রাজত্ব করে চলেছে আমাদের সকলের হৃদয়ে। সাহিত্য পাঠের সঙ্গে এমন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ভূভারতে আর দুটি নেই। 

খবরটি শেয়ার করুণ

1 thought on “ বই মেলার কথা ”

  1. লেখাটি ভালো হয়েছে। সামান্য তথ্যের ভ্রান্তি থাকলেও থাকতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top