মানব পাচনতন্ত্রে কীটনাশকের ক্ষতি মোকাবিলায় নতুন গবেষণা

উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় প্রোবায়োটিক চিকিৎসার সম্ভাবনা। আমেরিকার ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন, কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া কীভাবে মানব পাচনতন্ত্রের উপর কীটনাশকের প্রভাব মোকাবিলায় কাজ করে এবং শরীরকে বিষক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

গবেষকরা দেখেছেন যে, কীটনাশকের সংস্পর্শে মানবদেহের অন্ত্রে থাকা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। গবেষকরা ১৮টি বহুল ব্যবহৃত কৃষিজ কীটনাশক ও ১৭টি মানব অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির ওপর ল্যাবরেটরি ও পশু পরীক্ষায় প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। ফলাফলে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কীটনাশক ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়ায় গোলযোগ সৃষ্টি করে এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া কোষে জমা হতে শুরু করে।এই আণবিক মিথস্ক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য সংবলিত একটি “অ্যাটলাস” তৈরি করা হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ রোগ প্রক্রিয়া এবং সম্ভাব্য চিকিৎসা গবেষণায় সহায়ক হবে।

ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ধরনের পাচনতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া কীটনাশকের বিষাক্ত প্রভাব কমাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে প্রদাহ হ্রাস করে। এই আবিষ্কার কীটনাশকের সংস্পর্শে আসার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রোবায়োটিক থেরাপির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

কীটনাশক ডিটক্সিফিকেশনে পাচনতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে গবেষণার প্রধান লেখক ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির হিউম্যান সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক জিয়াংজিয়াং ঝু বলেন, “আমরা কীটনাশক বা পরিবেশ দূষণকারী পদার্থ মানব স্বাস্থ্যের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে তা আরও গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি। আমরা এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করেছি যা কীটনাশককে ভেঙে ফেলতে, অপসারণ করতে বা জৈবিক সিস্টেম থেকে পরিষ্কার করতে পারে। এটি ভবিষ্যতে খাদ্য ও জলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কারে সহায়ক হতে পারে।”

গবেষণাটি সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশনস-এ প্রকাশিত হয়েছে।গবেষকরা ১৮টি কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশক এবং ১৭টি পাচনতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া পরীক্ষা করেছেন। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো মানব পাচনতন্ত্রে সাধারণত পাওয়া চারটি প্রধান গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে এবং স্বাস্থ্য বজায় রাখতে বা রোগের কারণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরীক্ষায় ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে রয়েছে ডিডিটি, অ্যাট্রাজিন, পারমেথ্রিন এবং ক্লোরপাইরিফস। ঝু জানান, যদিও কিছু কীটনাশকের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তবুও এগুলোর অবশিষ্টাংশ মাটি ও জলে পাওয়া যায়।

প্রথম লেখক লি চেন, যিনি ঝু’র ল্যাবে সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, বলেন, “আমরা ব্যাকটেরিয়াকে কৃত্রিম ভাবে বৃদ্ধি করে কীটনাশকের প্রাসঙ্গিক ঘনত্বের সংস্পর্শে এনে দেখেছি তারা কীভাবে সাড়া দেয়।” ১০,০০০-এর বেশি নমুনা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষকরা একটি বিস্তারিত মিথস্ক্রিয়া মানচিত্র তৈরি করেছেন, যা দেখায় কোন কীটনাশক কোন ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত বা দমন করে এবং কোন প্রজাতি কীটনাশক শোষণ করে।

গবেষণায় ৩০৬টি কীটনাশক-ব্যাকটেরিয়া জোড়ার বিপাকীয় পরিবর্তন চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো পুষ্টি ভাঙার জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার আণবিক পণ্য – মেটাবোলাইটগুলোর উপর প্রভাব ফেলে। মেটাবোলাইটগুলো শক্তি উৎপাদন, কোষের কার্যকারিতা এবং ইমিউন সিস্টেমের সংকেত সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, লিপিড নামক অণুগুলোর উপর কীটনাশকের প্রভাবও বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা শরীরের বিভিন্ন কাজকর্মে অপরিহার্য।ম

গবেষকরা সুস্থ ইঁদুরের পাচনতন্ত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে জীবাণুমুক্ত করার পর Bacteroides ovatus নামক একটি সাধারণ পাচনতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করান। চার সপ্তাহ কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকার পর ফলাফল পরীক্ষাগারের ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। এই ব্যাকটেরিয়া কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে খুব কার্যকরী ছিল।

এ প্রসঙ্গে ঝু বলেন, “আমরা এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করেছি যা কীটনাশকের বিষাক্ত প্রভাবকে প্রশমিত করতে পারে,এবং শারীরিক ক্ষতি পুরোপুরি ঠিক করে দেয়। প্রদাহ সাধারণত শরীরের জন্য ক্ষতিকর। যদি কোনো বিষাক্ত পদার্থ এটি প্ররোচিত করে, এবং অন্য অণু এটির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে, তবে বড় ধরনের ক্ষতি প্রতিরোধে সমাধান পাওয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি হতে পারে যা বিষক্রিয়া বা প্রদাহ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হবে।”

এই গবেষণা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, প্রোবায়োটিক বা উপকারী অন্ত্র ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে শরীরের কীটনাশক-জনিত ক্ষতির একটি প্রতিকার সম্ভব হতে পারে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য, জল বা পরিবেশের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা কীটনাশক দূষণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা আগামী দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সূত্র-: “Mapping pesticide-induced metabolic alterations in human gut bacteria” by Li Chen, Hong Yan, Shanshan Di, Chao Guo, Huan Zhang, Shiqi Zhang, Andrew Gold, Yu Wang, Ming Hu, Dayong Wu, Caroline H. Johnson, Xinquan Wang and Jiangjiang Zhu, 10 May 2025, Nature Communications.
DOI: 10.1038/s41467-025-59747-6

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top