মানভূমের কৃষিপ্রবাদে শ্রমের মর্যাদা

নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ মানভূমের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী । তারা রোদে পুড়ে , জলে ভিজে , কঠোর পরিশ্রম করে কৃষিজ ফসল ফলায় । তাই , মানভূমের জনজীবন থেকে উদ্ভূত প্রবাদ, ধাঁধা , ছড়া , লোককথা , লোকগান ইত্যাদিতে কঠোর  কায়িক শ্রমের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধা প্রকাশিত হতে দেখা যায় । আলোচ্য প্রবন্ধে মানভুমের যেসব কৃষিপ্রবাদে কায়িক শ্রমের প্রতি মর্যাদা প্রকাশিত হয়েছে সে রকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত সহ আলোচনা করা যেতে পারে।

১ ) খাটবে ত চাটবে ।

( শব্দার্থ : খাটবে – পরিশ্রম করলে । চাটবে  :  ‘ চাটবে ‘ বলতে এখানে পরিশ্রমের ফলস্বরূপ খাবারের সংস্থান হবে  -একথা  বলা হয়েছে । )

আলোচ্য প্রবাদটির উদ্ভব হয়েছে মানভূমের  কৃষিকেন্দ্রিক সমাজেই ।

 বর্তমানে মানভূম তথা পুরুলিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে কৃষিকাজে কিছু কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতির যৎসামান্য ব্যবহার চোখে পড়লেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে কৃষিকাজ ছিল সম্পূর্ণ কায়িক শ্রমনির্ভর । চাষের কাজে লাঙ্গল চালানো , জমি তৈরি , বীজ বপন , ধান রোপণ ও ধান কাটা , ধান ঝাড়া , চাল তৈরি ইত্যাদি প্রত্যেকটি কাজেই কায়িক  শ্রমের প্রয়োজন হয় । তাই , চাষের কাজে যে যেমন পরিশ্রম করে , সে সেরকম ফল পায়। যে বেশি পরিশ্রম  করবে সে আশানুরূপ ফল পাবে এবং তার অন্নাভাবও থাকবে না ।

 ‘ খাটবে তো চাটবে ‘ প্রবাদটিতে কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিশ্রমের মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । এই নির্দেশ বিশ্বাস করলে কৃষক পরিশ্রমী হয়। আর পরিশ্রমের অন্ন সারা জীবন তাকে শান্তি দেয়।

২ )  চা আছে রস – যদি থাকে বাইন্দ দশ ।

 শব্দার্থ :  বাইন্দ –  আট ( ৮ ) মনে এক বাইন্দ ,  কোথাও কোথাও দশ (১০ ) মনে এক বাইন্দ ( unit measured by volume ) ;

রস : রস বলতে চাষের আনন্দ বা গুরুত্বকে বোঝানো হয়েছে। 

কৃষিকাজে প্রচুর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় । তাই, পারিশ্রমিক ব্যতীত এ শ্রম দেওয়া সহজ নয় । খুব স্বাভাবিকভাবেই কৃষক বিশ্বাস করেন তিনি যে পরিমাণ পরিশ্রম দেবেন সে পরিমাণ বা তার বেশি  উৎপাদন পারিশ্রমিক হিসাবে ফিরে পাবেন। কারণ , কৃষিকাজ ভালোভাবে সম্পাদন করতে হলে কৃষকের বাড়িতে প্রচুর ধানের যোগান থাকা প্রয়োজন। ধানের প্রাচুর্য না থাকলে ক্ষেতমজুরও নিয়োগ করা যায় না। এই বাস্তব চিত্র থেকে কৃষকের মনে হয় চাষে তখনই আনন্দ যদি ৮০ মন ফসল উৎপাদন করা যায়  ।এ বিশ্বাসই তাকে কৃষিকাজে অনুপ্রাণিত করে।

৩ ) চাষে রূপ নাশে –  কিন্তুক ঘর হাসে ।

কৃষিকাজে  কঠোর কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় ।রোদে-জলে-কাদায় চাষবাস করতে হয় বলে কৃষকদের শারীরিক সৌন্দর্যের হানি ঘটে – একথায় আলোচ্য প্রবাদটিতে ব্যক্ত হয়েছে । মূলত মানভূমঞ্চল ক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত । এই অঞ্চল সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে অবস্থিত বলে এখানে শীত গ্রীষ্মের প্রখরতা বেশি । এই ধরনের আবহাওয়ায় কৃষকদের কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের দ্বারা কৃষি কাজ করতে হয় বলে তাদের শারীরিক সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় । চাষের কাজে শারীরিক সৌন্দর্যের হানি ঘটলেও পরিশ্রমের বিনিময়ে ফসল প্রাপ্তির জন্য চাষির পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য আসে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের মান ভালো হয় ।

এই কারণেই বাস্তব জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এই প্রবাদটিতে পরিশ্রমের মর্যাদার দিকটিও প্রতিফলিত হয়েছে।

৪ )  চাষির গৌরব হয় যার দু চার ভাই ,     গোয়ালার গৌরব হয় যার দু চার গাই ।

কৃষিকাজ প্রধানত কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল । এখানে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় । তাই , কৃষিকাজে সহযোগির সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায় কৃষিকাজ তত ভালোভাবে সম্পন্ন হয় এবং ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় । সঙ্গত কারণেই , আলোচ্য প্রবাদটিতে বলা হয়েছে যে চাষির যত ভাই অর্থাৎ কৃষিকাজে সহযোগির সংখ্যা যত বেশি সেই চাষির ফসল উৎপাদন তত ভালো হয় এবং তার গৌরবও বৃদ্ধি পায়। অনুরূপভাবে যে গোয়ালার যত বেশি গাই থাকে তার দুধের উৎপাদনও বেশি হয় ।

 কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামবাংলায় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই আলোচ্য প্রবাদটি উঠে এসেছে । কৃষক বিশ্বাস করে কাজের জন্য লোকবলের প্রয়োজন । যত বেশি সহযোগির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ততই কৃষিকাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।

৫ ) আষাঢ় মাসের কাদাতে ,

  লাজ লাগছে কাছে দাঁড়াতে।

আষাঢ় মাসে বর্ষা শুরু হলে চাষিরা মনের আনন্দে পূর্ণ উদ্যমে চাষবাস শুরু করে । আষাঢ় মাসে অর্থাৎ চাষের প্রথম পর্যায়ে চাষির মনে এতটাই উদ্যম ও পরিশ্রম করার উৎসাহ থাকে যে জল-কাদায় শরীর সম্পূর্ণ কর্দমাক্ত হয়ে গেলেও সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকে না । কিন্তু কর্দমাক্ত শরীর এমন বিকৃতরূপ ধারণ করে যে চাষি অপরের কাছে দাঁড়াতে লজ্জাবোধ করে । আসলে এখানে লজ্জার মধ্য দিয়ে চাষির অসীম আনন্দের প্রকাশ ঘটেছে এবং পরিশ্রম করার গৌরব ঘোষিত হয়েছে । এই কৃষিসংক্রান্ত প্রবাদটিতে সুন্দর একটি মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করেছে যাতে আনন্দের প্রকাশে ‘ লজ্জা ‘ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

৬ ) শ্রাবনে জ্বরে অঘ্রানে ঘরে ,

     সে পুত হয়ে কেনে না মরে।

  শব্দার্থ : ঘরে : এখানে ‘ ঘরে ‘ বলতেনিষ্কর্মাহয়েবাড়িতেবসেথাকাকেবোঝানোহয়েছে ।

পুত : পুত্র ‌। এখানে ‘ পুত ‘ বলতে মূলত চাষিকে বোঝানো হয়েছে।

 কৃষকদের জীবন-জীবিকায় শ্রাবণ ও অগ্রহায়ণ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ।  মানভূম অঞ্চলে ধান চাষ হিসাবে মূলত আমন ধানের চাষই করা হয়। এই আমন ধান রোপণের উৎকৃষ্ট সময় হলো শ্রাবণ মাস । 

তাই , শ্রাবণ মাসে কোন চাষি যদি শারীরিক অসুস্থতার কারণে বা কোন অজুহাতে ঘরে বসে অলস নিষ্কর্মার জীবন যাপন করে তাহলে তার চাষের কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং আগামী দিনগুলি ফসল প্রাপ্তির অভাবহেতু কষ্টকর হয়ে ওঠে ।

 অনুরূপভাবে , অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার সময় কোন চাষি যদি ফসল কাটার কাজে নিযুক্ত না থেকে বাড়িতে অলস নিষ্কর্মার জীবন কাটায় তাহলে সেই চাষির জীবনও অভাব ও দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত হয় । তখন যেন তার বেঁচে থাকায় নিরর্থক হয়ে যায় । সেরকম পরিস্থিতিতে এরকম অলস চাষির বেঁচে থাকার নৈতিক অধিকারও যেন থাকে না । আলোচ্য প্রবাদটিতে প্রকৃতপক্ষে কৃষিকাজে পরিশ্রমের মর্যাদার কথায় তুলে ধরা হয়েছে।

 সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানভূমের বিভিন্ন কৃষিকেন্দ্রিক প্রবাদে চাষির কঠোর পরিশ্রমের মর্যাদা দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top