শূন্য বর্জ্য নীতি গ্রহনে জাপান আজ বিশ্বগুরু

উত্তরাপথঃ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ শহর জাপান । সম্প্রতি তার শূন্য বর্জ্য নীতি-এর কারণে খবরের শিরোনামে । Zero Waste বা  শূন্য বর্জ্য হল- অযথা খরচকে ন্যূনতম রেখে উৎপাদিত আবর্জনা কমানোর প্রচেষ্টা। ১৯৯৬ সালে , অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা বিশ্বের প্রথম শূন্য-বর্জ্য শহরের শিরোপা অর্জন করে।এরপর Zero Waste ধারণাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, উদাহরণস্বরূপ কানাডার টরন্টো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো নিজেদের শূন্য-বর্জ্য শহর হিসাবে ঘোষণা করে । পরিবেশ সচেতনতার  ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের প্রায় ৭০% পৌরসভা নিজেদের শূন্য-বর্জ্য পৌরসভা হিসাবে ঘোষণা করেছে।

এদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত, জাপানের পাঁচটি শহর নিজেদের শূন্য বর্জ্য শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে।জাপানের তোকুশিমা প্রিফেকচারের কামিকাতসু টাউন প্রথম নিজেদের শূন্য বর্জ্য  শহর হিসেবে ঘোষণা করার পর, ধারণাটি পুরো জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে,জাপানের বিভিন্ন পৌরসভা শূন্য বর্জ্য এই নীতির স্বপক্ষে প্রচার করছে। এই ভাবে জাপান  শূন্য বর্জ্য নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী অর্থাৎ কোনও জিনিসের সর্বাধিক পুনর্ব্যবহার করার জন্য জাপানের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং অন্যান্য দেশগুলির কাছে তাদের  অনুসরণ করার জন্য একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছে।

জাপান সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত জিরো ওয়েস্ট পলিসি্র প্রধান লক্ষ্য হল বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করা,সেইসাথে জিনিষপত্রের  পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করা । এই পলিসির সফল রুপায়নের জন্য সরকার প্রতিটি পরিবার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় পৌরসভা সহ বিভিন্ন সেক্টরকে  অন্তর্ভুক্ত করেছে।

জাপানের শূন্য বর্জ্য নীতি -এর একটি মূল স্তম্ভ হল “3Rs” এর প্রচার: হ্রাস করুন, পুনরায় ব্যবহার করুন এবং পুনর্ব্যবহার করুন।প্রথমে বর্জ্য হ্রাসের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, এরপর পণ্য ও উপকরণের পুনঃব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং প্রতিটি উপকরণের পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, জাপান বর্জ্য হ্রাস এবং মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য, জাপান বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ এবং নীতি বাস্তবায়ন করেছে।এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ২০২০ টোকিও আন্তর্জাতিক অলিম্পিকে ব্যবহৃত মেডেল যা পুরোটাই জাপান ই-বর্জ্য দিয়ে প্রস্তুত করেছিল । এই কাজের জন্য জাপান গত দুই বছর ধরে ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য সংগ্রহ করেছিল। মোট ৭৮,৯৮৫ টন বাতিল ডিভাইস সংগ্রহ করা হয়েছিল। যার মধ্যে মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা, হ্যান্ডহেল্ড গেমস এবং ল্যাপটপ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর সংগৃহীত বাতিল ডিভাইসগুলিকে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে ভেঙে ফেলা এবং গলানো হয়। ৩১ মার্চ, ২০১৯-এ বর্জ্য সংগ্রহ বন্ধ হওয়ার সময় ৩০.৩ কেজি সোনা, ৪,১০০ কেজি রৌপ্য এবং ২,৭০০ কেজি ব্রোঞ্জ ই-বর্জ্য থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যে পৌঁছেছিল জাপান।এই কাজের জন্য জাপান সারা দেশে পোস্ট অফিসগুলিতে এবং রাস্তার কোণে হলুদ দান বাক্স স্থাপন করে এবং দেশের ২,৪০০ টি স্টো্র থেকে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করেছিল।

Mizuno Corp. এবং Central Japan Railway Co. (JR Tokai) যৌথভাবে শিনকানসেন(বুলেট ট্রেন)এর উপাদান থেকে শিশুদের জন্য অ্যালুমিনিয়াম বেসবল ব্যাট তৈরি করেছে।এই ব্যাটগুলি প্রস্তুত করার জন্য স্ক্র্যাপ করা N700 সিরিজের ট্রেনের দেহগুলিকে গলিয়ে উচ্চ মানের বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম বের করা হচ্ছে, যা ব্যাটটিকে সাধারণ অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাটের মতোই স্থায়িত্ব দিচ্ছে সেইসাথে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকে ৯৭% কমাতে সাহায্য করছে।

জাপান সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । সারা বছর জাপানি নাগরিকদের তাদের বর্জ্য বিভিন্ন শ্রেণীতে বাছাই করতে হয়, যেমন প্লাস্টিক, কাগজ, কাচ এবং জৈব বর্জ্য। এই সূক্ষ্ম বর্জ্য বিভাজন বর্জ্য সংগ্রহ সহ এর পুনর্ব্যবহারকে আরও কার্যকরী করে, সেই সাথে এটি  ল্যান্ডফিলের উপর বোঝা কমাতে সাহায্য করে।

জাপান বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর কঠোর বিধান প্রয়োগ করেছে, নির্মাতাদের পরিবেশ-বান্ধব প্যাকেজিং গ্রহণ করতে এবং একক-ব্যবহারের প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে উৎসাহিত করছে। এই সক্রিয় পদ্ধতির ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে যা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিকে অনুপ্রাণিত করছে।

জাপানের জিরো ওয়েস্ট পলিসির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল সার্কুলার ইকোনমিতে ফোকাস। সম্পদ সঞ্চালনের ধারণাকে প্রচার করার মাধ্যমে, জাপানের লক্ষ্য হল যতটা সম্ভব উপকরণ এবং পণ্যগুলিকে পুনরায় ব্যবহার করা। যখন কোনও সম্পদ পুনর্ব্যবহৃত করা বা পুনরায় ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত ভাবে বর্জ্য হ্রাস করতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের উপর চাপ কমায় না বরং পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ এবং চাকরির সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কোটা মাচিদা এবং ইউয়া সাকাই ঘোষণা করেছেন যে তারা খাদ্য বর্জ্য শুকিয়ে এবং সংকুচিত করে অতি-শক্তিশালী সিমেন্ট তৈরি করেছেন।বিজ্ঞানীরা এই ১০০% বায়োডিগ্রেডেবল এবং সম্ভাব্য ভোজ্য সিমেন্ট তৈরি করতে  চীনা বাঁধাকপি, কলার খোসা এবং কফি বিন ব্যবহার করেছেন।

জাপানের শূন্য বর্জ্য নীতির সাফল্যের মূল কারণ হল সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের মধ্যে শক্তিশালী সহযোগিতা।দেশটি আজ সারা বিশ্বে ৮০% এরও বেশি বর্জ্য পুনর্ব্যবহৃত করে যেখানে আমাদের দেশে মাত্র ৩০%বর্জ্য পুনর্ব্যবহৃত হয়।জাপান সরকারের এই উদ্যোগ যেমন ল্যান্ডফিলকে ভরাট হওয়া থেকে রক্ষা করছে,তেমনি পরিবেশগত এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলি হ্রাস করতে সাহায্য করছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো ও বিশ্ব মঞ্চে ভারতের লোকনৃত্য

গার্গী আগরওয়ালা মাহাতোঃ আমাদের চারিদিকে বিশ্ব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে,পরিবর্তিত হচ্ছে শিল্প সাধনার প্রকৃতি। এই পরিবর্তিত শিল্প সাধনার যুগে আমাদের সেই সমস্ত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং সম্মান করা অপরিহার্য যারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এমনই একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো। নেপাল মাহাতো, যার ছৌনৃত্যের জগতে  দেশে ও বিদেশে অতুলনীয় অবদান তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী´এনে দিয়েছে। নেপাল মাহতোর জন্ম ১৭ জুন ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার থানার আদাবনা নামে একটি ছোট গ্রামে। তার পিতা স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ মাহাতো ও মাতা তুষ্ট মাহাতো। .....বিস্তারিত পড়ুন

শারদোৎসবের প্রস্তুতি শুরু কলকাতা পুরসভা এবং বন্দর কতৃপক্ষের

উত্তরাপথঃ শারদোৎসবের প্রস্তুতি শুরু প্রশাসনের, প্রতিমা বিসর্জনে এ বার বিশেষ বন্দোবস্ত করছে কলকাতা পুরসভা।এ বছর ২১ অক্টোবর দুর্গা পুজা শুরু এবং ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমী। বিজয়া দশমীর পর আরও দু’দিন প্রতিমা বিসর্জন করা যাবে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। তাই সেই প্রতিমা বিসর্জন পর্ব মসৃণ করতে কলকাতা বন্দর এবং পুরসভা কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে চলেছে। সোমবার কলকাতা পুরসভায় প্রাক্‌-পুজোর বৈঠকে পুরসভার বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের পাশাপাশি, ছিলেন কলকাতা পুলিশ, সিইএসসি-সহ একাধিক সরকারি দফতরের আধিকারিকেরা। .....বিস্তারিত পড়ুন

রবি কিরণে “আদিত্য”

ড. সায়ন বসুঃ বীর "বিক্রমে" চাঁদের মাটিতে পা রাখার পর এবার ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র (ISRO)-এর লক্ষ্য সূর্য | আমাদের ৮টি গ্রহ (প্লুটো এখন বামন গ্রহের তালিকায়) যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সেই সূর্যের দিকে পাড়ি দিয়েছে "আদিত্য" ২রা সেপ্টেম্বর| চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের ১০ দিনের মাথায় আদিত্যকে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়ে ISRO বাকি বিশ্বের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলির কাছে যে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে তা বলাই বাহুল্য| আদিত্য মিশনের সূচনা ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে|প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয় যে একটি ছোট এবং কম ওজনের (৪০০ কেজি) কৃত্রিম উপগ্রহকে low Earth orbit (LEO ;লিও) যে কক্ষপথের উচ্চতা ১,২০০ কিলোমিটারের থেকে কম সেখানে পাঠানো হবে এবং তার কাজ হবে সূর্যের একদম যে বাইরের স্তর যাকে আমরা সৌর-করোনা বলি তার সম্বন্ধে তথ্য পাঠানো। .....বিস্তারিত পড়ুন

পোল্ট্রি শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চলেছে নতুন জিন প্রযুক্তি

উত্তরাপথ - পোল্ট্রি শিল্পে পুরুষ ছানা মারার অভ্যাস দীর্ঘকাল ধরে নৈতিক উদ্বেগের বিষয়।পরিসংখ্যানে প্রকাশ প্রতি বছর পোলট্রিগুলিতে ৭ বিলিয়ন পুরুষ ছানাকে হত্যা করা হয়।কারণ পুরুষ ছানারা ডিম দিতে পারে না সেই সাথে তারা  মাংসের জন্যও উপযুক্ত না হওয়ার কারণে,তারা অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক বলে বিবেচিত হয় । সেই কারণে ডিম ফোটার পরপরই তাদের euthanized করা হয়।এবার এই সমস্যা সমাধানে মধ্য ইস্রায়েলের Yuval Cinnamon এর গবেষণাগারে এক নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয় যার দ্বারা সমস্ত ছানাই মহিলা হবে।এক্ষেত্রে পুরুষ ছানাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে ডিম থেকে বেরোনোর আগেই তাদের বাঁধা দেওয়া হবে। এই নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার মুর্গীর পুরুষ ছানাগুলিকে প্রায়শই ম্যাসারেশন বা গ্যাসিং পদ্ধতির মাধ্যমে হত্যা করার মত অমানবিক কাজ বন্ধ করতে সাহায্য করবে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top