শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ও দ্বারকা নগরী: ভক্তি, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল

গুজরাটের বর্তমান দ্বারকা শহরে অবস্থিত দ্বারকাধীশ মন্দির । ছবি- এক্স হ্যান্ডেল

প্রীতি গুপ্তাঃ ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় চরিত্র নন, বরং একই সাথে সর্ব শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, রাজনৈতিক কৌশলী, ন্যায়পরায়ণ রাজা এবং ভক্তের পরম বন্ধু।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী হল তাঁর জন্মদিন, যা প্রতি বছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয়। এই উৎসব ঘিরে আমাদের দেশে বহু শহর ও গ্রামে পালিত হয় নানা ধর্মীয় আচার, উপবাস, কীর্তন ও রাত্রিবেলা “জন্ম লীলা” অভিনয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় মথুরা নগরীতে, তাঁর পিতা বসুদেব এবং মাতা দেবকী ছিলেন রাজা উগ্রসেন এর বংশধর। কিন্তু দেবকীর দুষ্টভাই কংস যখন জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম সন্তানই তার মৃত্যুর কারণ হবে, তখন সে দেবকী-বসুদেবকে বন্দী করে রাখে এবং একে একে তাদের সন্তানদের হত্যা করে।
অষ্টম সন্তান জন্মের রাতে অলৌকিকভাবে কারাগারের দরজা খুলে যায়, নদী যমুনা পথ খুলে দেয় এবং শিশুটিকে গোকুলে নন্দযশোদার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই অলৌকিক ঘটনাই জন্মাষ্টমীর মূল উৎসবের কেন্দ্র।

আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাবে জন্মাষ্টমী পালনের রীতি রয়েছে।সেইদিন ভক্তরা সূর্যোদয় থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত উপবাস পালন করেন।সেইসাথে শ্রীকৃষ্ণের জীবনী নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গান ও গীতার পাঠ হয়। জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও কর্ণাটকে ‘দহি হান্ডি’ খেলা বিশেষ জনপ্রিয়, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের দই চুরি করার লীলা অনুকরণ করা হয়।সেইদিন রাত ১২টায়, শ্রীকৃষ্ণের জন্মক্ষণে মন্দিরে ঘণ্টা বাজে, শঙ্খধ্বনি হয় এবং ভক্তরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন।

দ্বারকা, গুজরাট রাজ্যের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে অবস্থিত একটি পৌরাণিক শহর, যা শ্রীকৃষ্ণের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। কংসের মৃত্যুর পর মথুরা ছেড়ে, শ্রীকৃষ্ণ ও যাদব বংশীরা সমুদ্রের ধারে এক নতুন নগরী নির্মাণ করেন, যার নাম দেন দ্বারকা

 দ্বারকার বিশেষত্ব:

  • পৌরাণিক মতে, দ্বারকা ছিল স্বর্ণমণ্ডিত প্রাসাদ, অট্টালিকা ও সমৃদ্ধির এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
  • মহাভারতের যুদ্ধের বেশ কিছু বছর পর দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায় বলে উল্লেখ আছে।
  • ১৯৮৮-২০০১ সালে ভারতের মেরিন আর্কিওলজি ইউনিট (NIOT) সমুদ্রতলে এক রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়, যা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-২০০০ সালের মধ্যে এক সুবিশাল শহরের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয় — অনেকের মনে করেন সেটিই পৌরাণিক দ্বারকা।

শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাধীশ মন্দিরে ।ছবি- এক্স হ্যান্ডেল

গুজরাটের বর্তমান দ্বারকা শহরে অবস্থিত দ্বারকাধীশ মন্দির (অর্থাৎ “দ্বারকার রাজা” শ্রীকৃষ্ণের মন্দির) ভারতের অন্যতম পবিত্র ও প্রাচীন মন্দির।এখানে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাধীশ বা রঞ্ছোড়জী রূপে পূজিত হন। এই মন্দিরটির প্রাচীন নাম জগৎ মন্দির।এই মন্দিরটি ৭-তলা বিশিষ্ট, এবং চুনা-পাথরে নির্মিত, স্থাপনাকাল প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে (পরবর্তীতে পুনর্নির্মাণ হয়) প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এখানে দর্শন করতে আসেন।

কৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা এবং তাঁর রাজধানী দ্বারকা তাঁর জীবনের দুটি ভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করে। মথুরা তাঁর শৈশব ও যৌবনের লীলার সাক্ষী, যেখানে তিনি গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা করেছেন এবং কংসের অত্যাচার থেকে প্রজাদের মুক্তি দিয়েছেন। অন্যদিকে, দ্বারকা তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতীক, যেখানে তিনি একজন রাজা ও কূটনীতিক হিসেবে যাদবদের শাসন করেছেন।

শ্রীকৃষ্ণ কেবল একজন দেবতা নন, তিনি জীবনের সর্বাঙ্গীন দর্শন। তাঁর মুখে উচ্চারিত ভগবদ্গীতা মানব জীবনের এক অনন্ত পথপ্রদর্শক।

  • তিনি শিখিয়েছেন নিঃস্বার্থ কর্ম,
  • দেখিয়েছেন ভক্তির মহিমা,
  • প্রতিষ্ঠা করেছেন ধর্মের শাশ্বত রূপ

শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী এবং দ্বারকা নগরী কেবল ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়, ইতিহাস, পুরাণ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানচেতনার মেলবন্ধন।একদিকে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও লীলা মানবজাতিকে শিক্ষা দেয় কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, অন্যদিকে দ্বারকা নগরী আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক হারানো সভ্যতার রহস্যময় ইতিহাস।এই দুই মিলে গড়ে ওঠেছে এক মহাজাগতিক বর্ণময় কাহিনি, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top