

গার্গী আগরওয়ালা মাহাতোঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নাম। যাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক । যিনি নারী চরিত্রের সূক্ষ্ম চিত্রায়নের জন্য বিখ্যাত। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে শরৎ সাহিত্যের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। তিনি কখনও কখনও অনিলা দেবী ছদ্মনামেও লিখতেন। শরৎচন্দ্রের নায়িকা বলতে তার উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্রগুলিকে বলা হচ্ছে। এইসব চরিত্র বাংলা সাহিত্যে অনেক চরিত্রের ভিড়েও তাদের নিজস্ব প্রবণতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কারণে আজও জীবন্ত চরিত্র হিসাবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই সময়ে নতুন প্রজন্মের উত্তরসূরি শরৎচন্দ্র নারী অধিকার আর মর্যাদা রক্ষায় সমাজ ব্যবস্থার মূল রক্ষণশীল ধারাকে তীক্ষ্ন বিদ্রুপে কটাক্ষ করেছেন। তার বড়দিদি উপন্যাসের নায়িকা বড়দিদি ‘মাধবী দেবী’ কিংবা ‘দেবদাস’-এর ‘পার্বতী’সহ সাড়া জাগানো উপন্যাসের নায়িকারা আজও পাঠক সমাজের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানবিক আবেগ এবং সামাজিক বাস্তবতার জটিলতা চিত্রিত করার দক্ষতার জন্য প্রশংসিত। শরৎ উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে এবং একই সাথে সামাজিক রীতিনীতির সমালোচনাও করে।
শরৎচন্দ্র পঁচিশ বছর (১৯১৩-১৯৩৮) একটানা মেয়েদের কথা লিখেছেন অবিস্মরণীয় যেসব নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তা আজও জনপ্রিয়। সেসব নারীর কেউ কেউ সাধারণ মেয়ে, কেউ বা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, আবার কেউ বা নিম্নবর্গ কিংবা সমাজের দৃষ্টিতে ভ্রষ্টা। অবিরত লিখে গেছেন প্রেমাকুল মেয়েদের গল্প। শুধু নারীই নয়, সকল মানুষের অন্তরের নিগূঢ় রহস্যে ডুব দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি ভারতে উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তনের সময় লেখা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নারীর মর্যাদা উন্নত করার লক্ষ্যে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের উত্থান দেখা দেয়। তবে, ঐতিহ্যগত রীতিনীতি টিকে থাকে, যার ফলে আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের মধ্যে একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারী চরিত্রগুলি প্রায়শই এই সংগ্রামকে মূর্ত করে তোলে, যার মাধ্যমে পাঠকরা সেইসময়ের বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের সম্পর্কে একটি আভাষ পেতে পারেন।তিনি তার উপন্যাসে পতিতা, বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, অরক্ষণীয়া অথবা বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম- তা সে যেমনটাই হোক না কেন সহজ-সরল ভাষায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো আবেগ ও উচ্ছ্বাসে অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে উপস্থাপিত হয়েছে। রোমান্টিক ভাবে স্থান পেয়েছে। *দেবদাস*-এ, পারো চরিত্রটি একজন অসাধারণ ট্র্যাজিক নায়িকার প্রতিনিধিত্ব করে। দেবদাসের প্রতি পারোর ভালোবাসা গভীর, তবুও সামাজিক প্রত্যাশা এবং পারিবারিক চাপ তাকে অসুখী করে তোলে। শরৎচন্দ্র তার ত্যাগ এবং সমাজের দ্বারা তার উপর আরোপিত সীমাবদ্ধতার একটি মর্মস্পর্শী চিত্র এঁকেছেন। পারোর চরিত্রটি নারীর কর্তৃত্ব এবং আবেগের প্রকাশকে সীমাবদ্ধ করে এমন সামাজিক রীতিনীতির তিনি সমালোচনা করেন।
*বিচিত্রা*-তে, মূখ্য চরিত্র, বিচিত্রা, একজন বহুমুখী চরিত্র যিনি ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাকে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন এবং স্বাধীন হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে,যিনি প্রায়শই স্থিতাবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিচিত্রার মাধ্যমে, শরৎচন্দ্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আত্মপরিচয় এবং স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামের বিষয়বস্তু অন্বেষণ করেন। তার সৃষ্ট এই চরিত্রটি নারীদের উদীয়মান চেতনাকে প্রতিফলিত করে, যা তাকে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক দৃশ্যপটে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব করে তোলে।
‘পল্লী সমাজে’-উপন্যাসে শরৎচন্দ্র একটি সম্প্রদায়ের প্রেক্ষাপটে নারী চরিত্রগুলির একটি বিস্তৃত চিত্রায়ন উপস্থাপন করেন। এই উপন্যাসে নারীদেরকে স্থিতিস্থাপক এবং সম্পদশালী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যারা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এই উপস্থাপনা প্রতিকূলতার মুখে নারীদের মধ্যে সংহতির গুরুত্বকে তুলে ধরে এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।
এছাড়াও গৃহদাহ’ উপন্যাসে একদিকে অচলা অন্যদিকে মৃণাল, চরিত্রহীনের একদিকে সাবিত্রী অন্যদিকে কিরণময়ী, তবে ‘শেষ প্রশ্ন’র কমল একেবারে আলাদা। ‘পথের দাবী’র ভারতী, তারও আগে‘বিন্দুর ছেলে’র বিন্দুবাসিনী, ‘মেজদিদি’র হেমাঙ্গিনী এবং‘নিষ্কৃতি’র শৈলজা সরল ও স্নেহপ্রবণ নারীদের অন্যতম দৃষ্টান্ত। এসব নারীর পাশে ‘শুভদা’র কাত্যায়নী এবং ‘আঁধারে আলো’র বিজলীর মতো বারবনিতার আখ্যানও পাঠকদের হৃদয়কে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে।
তিনি মূলত মানুষের মনুষ্যত্বকেই বড় করে দেখেছেন। এ জন্য নারীর জীবনের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখকে অপরিসীম সহানুভূতি ও দরদে রাঙিয়ে তুলেছেন। সমাজের মানদণ্ডে যেসব নারী চরিত্রহীন, তাদের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মনুষ্যত্ব। সমাজের অন্যায়-অত্যাচারে মানুষের হঠাৎ স্খলন হলে তাকে চিরকালের জন্য সমাজবহির্ভূত গণ্য করা, শরত্চন্দ্রের দৃষ্টিতে নিতান্ত অন্যায়।
শরৎচন্দ্রের মতে, ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।’ সমাজের অসহায়-উপেক্ষিত নারীর প্রতি অসীম দরদের পাশাপাশি শোষণ-উত্পীড়নের বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্র ছিলেন বরাবরই আপসহীন, খড়্গহস্ত। প্রকৃতপক্ষে এরই মধ্য দিয়ে ‘শরত্চন্দ্র তাঁর গল্প-উপন্যাসে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারী চরিত্রের চিত্রায়ন তাঁর সময়ের লিঙ্গ গতিশীলতার মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। তাঁর সূক্ষ্ম উপস্থাপনাগুলি ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং নারীর কর্তৃত্ব এবং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলে। শরৎ চন্দ্রের সাহিত্য কেবল একটি সমকালীন সমাজের চিত্র নয়, বরং তা আজকের নারীদের জন্যও একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তাঁর লেখার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, নারীরা যে সমাজে বাস করেন, সেখানে এখনও কতটা অন্ধকার রয়েছে, এবং সেই অন্ধকারকে দূর করার জন্য আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
আরও পড়ুন
তৃণমূলের রাজ্যসভা প্রার্থী
উত্তরাপথ: রাজ্যসভার প্রার্থী অবশেষে ঘোষণা করল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস।আগামী ২৪ জুলাই রাজ্যসভা নির্বাচন। আজ ৬ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিলো দল । এরা হলেন সুখেন্দুশেখর রায়,ডেরেক ও’ব্রায়েনও দোলা সেন।এরা গত রাজ্যসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন। এই ৩ জন যে পুনরায় টিকিট পাবেন তা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না । জল্পনা চলছিল বাকি ৩ টি আসনে তৃণমূল কাদের পাঠাবে সেই নিয়ে। বাকি ৩ টি আসনের জন্য প্রার্থী করা হয়েছে সমিরুল ইসলাম, প্রকাশ চিক বরাইক এবং সাকেত গোখলেকে। তৃণমূল কংগ্রেস শান্তা ছেত্রী এবং সুস্মিতা দেবের জায়গায় .....বিস্তারিত পড়ুন
Banarasi Saree: ভারতের হৃদয় থেকে একটি কালজয়ী ধন
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: ভারত তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত, এবং ভারতীয় কারুশিল্পের সবচেয়ে আইকনিক প্রতীকগুলির মধ্যে একটি হল বেনারসি শাড়ি। জটিল ডিজাইন এবং বিলাসবহুল কাপড় দিয়ে বোনা, বেনারসি শাড়ি ভারতীয় মহিলাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এবার আসাযাক ভারতের প্রাচীন শহর বারাণসী থেকে ভারতীয় ফ্যাশনের একটি কালজয়ী ধন হয়ে ওঠার বেনারসির যাত্রা। বেনারসি শাড়ির উৎপত্তি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রাচীন শহর বারাণসী (পূর্বে বেনারস নামে পরিচিত) থেকে বলে .....বিস্তারিত পড়ুন
ICC টুর্নামেন্ট জিতলে পুরুষ ও মহিলাদের দল একই অর্থ পাবে
উত্তরাপথ: এবার থেকে ICC টুর্নামেন্ট জিতলে পুরুষ ও মহিলা দলের প্রাইজ মানি একই। ডারবানে বসেছে আইসিসি-র (ICC) বার্ষিক বৈঠক সেখানেই স্থির হয়েছে । ICC-র চেয়ারম্যান গ্রেগ বার্কলে বলেছেন, ”ক্রিকেটের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত এটি। আমি অত্যন্ত খুশি যে পুরুষ ও মহিলাদের দল আইসিসি-র ইভেন্টে এবার প্রাইজ মানি হিসেবে একই অর্থ পাবে।” তিনি আরও বলেন, ”২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর আমরা মহিলাদের ইভেন্টের প্রাইজ মানি বাড়িয়ে এসেছি, উদ্দেশ্য ছিল একটাই। মহিলাদের বিশ্বকাপ জয় এবং পুরুষদের বিশ্বকাপ জয়ের আর্থিক পুরস্কার এক হবে .....বিস্তারিত পড়ুন
Sustainable Energy: সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি
উত্তরাপথ: সম্প্রতি একটি রিপোর্ট সামনে এসেছে তাতে সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি ১২% উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এই পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদের ব্যবহার আমাদের অ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের বিকল্পের দিকে ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করছে। সৌর এবং বায়ু শক্তির ব্যবহারের দ্রুত বৃদ্ধি বিভিন্ন কারণ দ্বারা চালিত হয়েছে। প্রথমত, প্রযুক্তির অগ্রগতি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং সাশ্রয়ী করে তুলেছে। সৌর প্যানেল এবং বায়ু টারবাইনগুলি এখন আগের চেয়ে আরও দক্ষতার সাথে সূর্য এবং বায়ু থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম, যার ফলে বিশ্বব্যাপী পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি .....বিস্তারিত পড়ুন