লুপ্তপ্রায় লোকগান : ছাদ পেটানো গান

ছবি প্রতিকী

নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ বেশ কিছুকাল আগেও গ্রামবাংলায় ছাদ পেটানো গানের প্রচলন ছিল । চুন- সুরকির ভাগ যথাযথ রাখা না হলে ভালো ছাদ তৈরি হয় না। তবে, বর্তমানে এই ধরনের ছাদ তৈরিতে খরচ বেশি বলে এবং দক্ষ কারিগরের অভাবে পেটানো ছাদের প্রচলন নেই বললেই চলে । তার জায়গায় এখন প্রায় সর্বত্র সিমেন্ট- বালি – পাথর সহযোগে ঢালাই ছাদের প্রচলন দেখা যায় ।

পূর্বে পেটানো ছাদ তৈরির সময় পেটানোর একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্যে , ঘুম তাড়ানোর জন্যে , কাজের ছন্দ বজায় রাখার জন্যে কাজে নিযুক্ত মিস্ত্রি থেকে শ্রমিকেরা এক ধরনের গান গাইত । মিস্ত্রিদের সাহায্যকারী নারী বা পুরুষ মজুরের দল সুর করে গান গাইত এবং গানের তালে ছাদ পেটানোর  কাজ করত।

 মানভূমে নারী শ্রমিকেরা ছাদ পেটানোর সময় এক ধরনের ঝুমুর গাইত । মুর্শিদাবাদের ডোমকল অঞ্চলে রাজমিস্ত্রিদের মধ্যে ছাদ পেটানো গানের প্রচলন দেখা যায় । সেখানকার ছাদ পেটানো গানে আলকাপ- এর প্রভাব দেখা যায় ।

 প্রকৃতপক্ষে ছাদ পেটানো গানে কাজের আনন্দ বজায় থাকে । এ ধরনের শ্রমগানে আশেপাশের শ্রোতারাও আনন্দ অনুভব করে ।  এই ধরনের গানে আদি রস ও কৌতুক রসের মিশ্রণ দেখা যায়। আবার , কোনো কোনো গানে আত্মকথন , জীবন- অভিজ্ঞতা , দৈনন্দিন জীবনের সুখ- দুঃখ , মালিকপক্ষের প্রতি অসন্তোষ ইত্যাদি ব্যক্ত হতে দেখা যায় ‌। 

 কাঠের দণ্ড বা কুপা দিয়ে ছাদ পেটানো হয়। গানের ছন্দের সঙ্গে কাঠের দন্ড উঠে আর নামে । গানের সঙ্গে কাঠের শব্দ মিশে যায় ।

 ছাদ পেটানো গান :

 ১ )  মনে ছিল বড় বাসনা ,  ছাদ পিটানো   

  ফলার খাব,

 ফলার দিলো না ।

 কুপার ঘা এট্টে মেরো না ,

সস্তার বাজারে বাবু ফলার দিল না ,

ঘোষ বলে দিব দিব , ঘোষাল বলে দিব না 

 কুপার ঘা এট্টে মেরো না ।

২ ) ঘোলা জলের আদা পানায় ছিঁড়লো বধুর

 শাড়ি ,

নাচের তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি ।

 ও ছাদ যে পিটাইবে সে কুপা ধরেছে ,

 ঠান্ডা ঝোরের পানি এনে ছিটা মার হে ।

দৈ এর মত চুনের জল খাচ্ছে গড়াগড়ি 

 নাচের  তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি,

 ও বঁধূ কুপা নিয়েছে , বঁধূ চোখ মেরেছে ,

 বঁধূ হাতে কুপা দেখে ছোকরা মেতেছে ,

 হাটের মাঝে বঁধূ বুঝি ভাঙ্গবে ভাতের হাড়ি ,

 নাচের তালে ছোকরা বন্ধু ছাদে মারো বাড়ি।

৩ )  ছোকরা বন্ধ ছাদ পেটায়,বঁধূর মুখে হাসি 

 ছোকরা বুঝতে পেরেছে, বঁধূ মেতে গিয়েছে।

 তালে তালে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে ।

 ছোকরা বুঝতে পেরেছে  খেলা শুরু হয়েছে। 

কুপার তালে প্রেমের খেলা দেখবে এসো হে, 

দয়াল গুরুর নামেতে ছাদ হইল কষাকষি , 

হাতের কুপা ফেলে বন্ধু বাজাও মোহন বাঁশি । 

দয়াল গুরুর নামে এবার তুলো তিনের বাড়ি।

৪ ) ‘ আমি একজন রাজমিস্ত্রি  ‘ গানটিতে আত্মকথন ও মালিক শ্রেণির প্রতি শ্রমিক-মজুরদের অসন্তোষ ব্যক্ত হয়েছে – 

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি, 

টাকা নিব, ঘর করিব গো ,

ওই আমরা করিব না জুয়াচুরি ।

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি,

 ঘর করিব বলে মোরা আছি আছি হেথায় ,

 টাকা পয়সা মারিয়ে দিয়ে মালিক পালিয়ে 

গেল কোথায় ,

এখন আমরা পড়লাম ফ্যারে কি করি উপায়,

হায়, আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর

 তৈয়ারি ।

মালিক খুঁজে বের করিব , টাকা-পয়সা না

 দিলে,

 ঘর ফেলে দিব ।

 কি করিবে বোকা মালিক, রবে তুমি শুয়ে 

কোথায় ?

আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

 গরিব খাটিয়ে ফাঁকি দিলে চলে যাবে গো 

এই সংসারে কালে ।

পরকালে পড়বে গো ফ্যারে – 

ভগবান তোমারে না দেবে রে , হায়

 আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

 বড় কষ্টে ঘর করিলাম , মাচায় মাচায় ছুটে

 বেড়াইলাম ,

প্রানের ভয় নাহি করিলাম ।

শেষকালে পয়সা নাহি পাই,

 আমি রাজমিস্ত্রি করি একখান ঘর তৈয়ারি।

৫ )  ও ছাদে যে খেলিবে সে নাইতে গিয়েছে ,

 ঘোলা জলে অঙ্গের শাড়ি লেপ্টে গিয়েছে ।

 কুপার ( কাঠের দন্ড )  তালে ঘোলা জলে

 ভিজলো বঁধূর শাড়ি ,

 ছাদ পিটাও হে নয়া বঁধূ , কইরোনা আড়ি ।

ও যে ছাদ পিটাইবে  সে ইশারায় ডাকে ,

সুরকি মাখা পানি তাহার মাথায় ঢাল হে ,

 ছাদ পিটাও হে নয়া বন্ধু মার  কুপার বাড়ি ,

 কইরো না আর আড়ি ।।

 ছাদ পেটানো গানের প্রচলন আজ প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে । বর্তমানে সর্বত্র ঢালাই ছাদের ব্যবহার দেখা যায় ‌। ছাদ পেটানো গানগুলি যদি লিখিত আকারে ধরে রাখা না হয় , তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এগুলি সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত থেকে যাবে । অথচ এই গানগুলি লোকসংস্কৃতির জগতে বিশেষত লোকগানের আঙিনায় অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তথ্য সহায়তা ও ঋণ স্বীকার :

শ্রম সঙ্গীত :  শক্তিনাথ ঝা , লোকসংস্কৃতি ও

 আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র , তথ্য ও সংস্কৃতি 

বিভাগ , পশ্চিমবঙ্গ সরকার , প্রথম প্রকাশ : 

জুন  , ২০০৩  ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top