

প্রীতি গুপ্তাঃ ভারত বহু প্রাচীনকাল থেকেই তাঁর জ্ঞান ও দর্শনের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার বহন করে চলেছে—আর্যভট্ট থেকে শুরু করে সি.ভি. রামান পর্যন্ত। এক সময় যে ভারতবর্ষ সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে , আজ সেই ভারতবর্ষই বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক অনুসন্ধানে ক্রমাগত অবনতির দিকে। এখন প্রশ্ন আমাদের সমাজ থেকে কি বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারা হারিয়ে যাচ্ছে?
আজকের ভারতে যুক্তিবাদ, গবেষণা ও সমালোচনামূলক চিন্তার জায়গায় দেখা দিয়েছে বিশ্বাসভিত্তিক মতবাদ, ছদ্মবিজ্ঞান আর রাজনৈতিক প্রভাব। এর প্রভাব শুধু ক্লাসরুম বা গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ নয়—এর প্রভাব পড়ছে পুরো সমাজে, আমাদের শেখার পদ্ধতিতে এবং সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতায়।
২০২৩ সালে ভারত সরকার “ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NRF)” চালু করল—উদ্দেশ্য গবেষণাকে উৎসাহ দেওয়া। কাগজপত্রের ঝামেলা কমানো, বেশি ফান্ড দেওয়া, বিজ্ঞানীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া— আপাতদৃষ্টিতে সরকারের সমস্ত উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে—যদি রাজনীতি বা মতাদর্শ তাদের নিয়ন্ত্রণ করে—তাহলে এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে?
ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখনও চাপে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বদলে রাজনৈতিক আনুগত্য দেখে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। স্বাধীন গবেষণার জন্য তহবিল কমছে। এমনকি পাঠ্যসূচিতেও চাপ আসছে যেন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতকে সমর্থন করা হয়।সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো—ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রকে “আধুনিক বিজ্ঞান” বলে প্রমাণ করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে বিশ্বাস আর প্রমাণের মধ্যে সীমারেখা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে এই করুন অবস্থা আজ শুধু ভারতের নয় , বিশ্বের অনেক দেশেরই একই অবস্থা। আমেরিকা, হাঙ্গেরি, তুরস্ক—সব জায়গাতেই একধরনের মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা-গবেষণার উপর চাপ সৃষ্টি করছে। V-Dem ইনস্টিটিউট বলছে, ভারত এখন “সম্পূর্ণভাবে সীমিত” একাডেমিক স্বাধীনতার দেশগুলোর মধ্যে পড়ে। গণতন্ত্রের জন্য এটা এক বড় সতর্ক সংকেত।
ছদ্মবিজ্ঞান (pseudoscience)—অর্থাৎ এমন কিছু বিশ্বাস বা প্রথা যেগুলো বিজ্ঞান বলে চালানো হয় কিন্তু যার কোনো প্রমাণ নেই—এটা এখন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
কোভিড-১৯ এর সময় সরকারের AYUSH মন্ত্রক অনেক বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি (আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি) প্রচার করেছিল যেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ছিল। কেউ কেউ তো দাবি করেছিলেন গোমূত্র বা গোবর দিয়ে করোনা সারানো সম্ভব—কিন্তু এর পিছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছিল না।
এদিকে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং এমন অনেক বিষয়ের জায়গা মিলছে একাডেমিক পাঠ্যক্রমে। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে, আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের বৈজ্ঞানিক ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।শুধু বিজ্ঞান নয়—ইতিহাসও আজ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। দেশের অতীতকে হিন্দুত্বের আদর্শে সাজিয়ে নতুন এক “জাতীয় পরিচয়” গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-র উদাহরণ ধরুন। আগে এটা ছিল এক নিরপেক্ষ, গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন অনেকেই বলছেন, এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়েছে—বিশেষ করে অযোধ্যা সংক্রান্ত খননের সময়। ইতিহাস যদি রাজনীতি ঠিক করে দেয়, তাহলে সত্য হারিয়ে যায়।
এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষকদের সমস্যা নয়—এটা আমাদের সবার সমস্যা। কারণ সত্য জানার, প্রশ্ন করার ও শেখার স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে উন্নয়ন থেমে যায়। শিক্ষাও তখন প্রোপাগান্ডায় পরিণত হয় ,আর একটা স্বাধীন গণতন্ত্র ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
সমাধানের উপায় কী?
ভারতের এখন দরকার:
• শিক্ষা ও গবেষণার স্বাধীনতা রক্ষা করা
• বিজ্ঞান আর মতাদর্শকে আলাদা রাখা
• প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান ও শিক্ষা প্রচার করা
• অন্ধবিশ্বাসের বদলে যুক্তিবাদ শেখানো
ভারতের মানুষের মেধা অসাধারণ। এখন দরকার সেই মেধাকে বিকাশের স্বাধীনতা দেওয়া—রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন –
• মীরা নন্দার A Field Guide to Post-Truth India
• V-Dem ইনস্টিটিউটের Academic Freedom Index 2024
• আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া নিয়ে জাতিগত গবেষণা
আরও পড়ুন
Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি
উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন
দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?
উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে। বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী? আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত? পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না? এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন
Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে
উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন
World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?
প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন