মানভূমে প্রচলিত রাত কহনি

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাত

গরাম থান

পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে (মানভূম ) সন্ধ্যার ঠিক কিছু পরেই ঠাকুমা , দিদিমা, পিসিমা , মাসিমারা ছোটদের নানা রূপকথা , উপকথা  শোনায় যেগুলি ‘ রাত কহনি ‘ নামে পরিচিত।এরকম রাত কহনির দু একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।

কুদরা ভূত-এর কহনি

পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসী সমাজে  ‘ কুদরা ‘ এক বিশেষ  ভূত বা অপদেবতা হিসাবে প্রতীয়মান হন। এই অঞ্চলের কৃষকেরা  বিশ্বাস করে যে, কুদরা ভূতকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের মঙ্গল হবে এবং অধিক ফসল উৎপাদন ও তা রক্ষা করা সম্ভব হবে। আবার কুদরা ভূত অসন্তুষ্ট হলে চাষির ভয়ানক অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে। চাষিরা কুদরা ভূতের সন্তুষ্টি জন্য ছাগল পাঁঠা, ভেড়া, শুকর, লাল মোরগ ইত্যাদি বলি দেয়। তারা বিশ্বাস করে, এর ফলে শস্য উৎপাদন ভালো হবে এবং তা রক্ষা করাও সম্ভব হবে। অন্যদিকে কুদরা ভুত অসন্তুষ্ট হলে শস্যহানি ঘটে। এমনকি গো গাড়ির লিঘা (axle)  ধরে ঝুলে পড়ে কুদরা ভূত গাড়ি অচল করে দেবে। চাষিদের এই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায় নিম্নোক্ত  কহনিটিতে ( কাহিনিটিতে )। জঙ্গলের মধ্যবর্তী স্থানে এক চাষির একটি বিশাল চাষের জমি ছিল। ওই জমির আইলে বড় বড় গাছ ছিল। যাতায়াতের রাস্তা সংকীর্ণ। রাস্তার দুপাশে ঘন কাঁটার ঝোপ-ঝাড় ছিল। এই জঙ্গলময় পথে লোকজনের যাতায়াতও খুব কম। জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় নানা জৈব উপাদানের সমবায়ে এই কৃষি জমির উর্বরতা শক্তিও বেশ ভালো। তাই ওই জমিতে শস্য অর্থাৎ ধানের ফলন  খুবেই ভালো হয়।  আশেপাশের গ্রামের  মানুষজনের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, ওই কৃষিজমির মালিকের কূলদেবতা ( যদিও ভূত বা অপদেবতা হিসাবেই বেশি পরিচিত ) কুদরা জমির আইলের গাছে অধিষ্ঠান করেন এবং জমির ফসলকেও তিনি সমস্ত রকমের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করেন। কুদরা দেবতার জন্যেই কোন দুঃসাহসিক চোর ওই জমি থেকে ধান চুরি করতে পারেনা।একবার নাকি এক চোর রাত্রে ওই জমিতে ধান চুরি করতে গিয়ে কুদরার তাড়া খেয়ে অচৈতন্য হয়ে সকাল পর্যন্ত ক্ষেতের মধ্যে পড়েছিল। তার নাকে, মুখে রক্তের দাগ। সকালে জমির মালিক ক্ষেত পরিদর্শনে সেখানে গেলে কোনরকমে জ্ঞান ফিরে পাওয়া ওই চোর চাষির পা ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে এবং তাকে সবিস্তারে তার দুরবস্থার কথা জানায়। ক্রমে এই কাহিনি আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই থেকে ওই জমিতে আর ধান চুরি হয় না। ক্ষেতের মালিক খুশি হয়ে কুদরা দেবতার সন্তুষ্টির জন্যে প্রতিবছর পাঁঠা ছাগল বলি দিয়ে পূজা করে।

কুদরা ভুতের কাহিনিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য : 

কুদরা ভুতের কাহিনিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হিসাবে বলা যেতে পারে চালাক, বুদ্ধিমান জমির মালিক অশিক্ষিত, মূর্খ, গ্রামীণ সাধারণ- এর মধ্যে অপদেবতার ভীতি জাগরুক রেখে নিজের ফসল রক্ষা করে এবং নির্ঝঞ্ঝাটে তা বাড়িতে আনা নিশ্চিত করে। অবশ্য একথা সত্য,  এই একবিংশ শতাব্দীতেও শুধু চাষিদের নয়, অধিকাংশ মানুষের মন থেকে ঠাকুর, ভূত, প্রেত, ডাইনি ইত্যাদির প্রতি ভয় মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। 

বাঁইড়্যা ভূত ও সন্ন্যাসী ঠাকুরের কহনি:

কোনো এক গ্রামে দুটি গোষ্ঠীভূক্ত লোকের বসবাস। এক গোষ্ঠীর কূলদেবতা সন্ন্যাসী ঠাকুর এবং অপর গোষ্ঠীর কূলদেবতা বাঁইড়্যা ভূত। যাদের কূলদেবতা সন্ন্যাসী ঠাকুর তারা ওই গ্রামে মধ্যসত্তভোগী জমিদার ছিলেন।  তাদের ধন, জন, মান, প্রভাব, প্রতিপত্তি – সবই বেশি ছিল। তারা প্রতিবছর আখ্যান যাত্রার দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ ঘটা করে সন্ন্যাসী ঠাকুরের পূজা করেন। নতুন কল্কায় গাঁজা, ধুপ, ধুনা নৈবেদ্য দিয়ে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে তুষ্ট করেন। কারণ তিনিই শস্য, ধন, জন, মান,  প্রভাব- প্রতিপত্তির রক্ষাকর্তা। তাই ওই গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের সময় থেকে মুখে মুখে চলে আসছে সন্ন্যাসী ঠাকুরের গুণগান। তৎকালে সন্ন্যাসী ঠাকুরের বিচরণ তারা দেখতে পেতেন – এরকম বিশ্বাস গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত আছে। তিথি অনুসারে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে রাত্রেবেলা দেখা যেত সাদা ধুতি পরিহিত, উর্ধাঙ্গ বস্ত্রহীন, কাঁধে পৈতা, হাতে চিমটা (খঞ্জনি জাতীয় ) ,পায়ে খড়ম, মাথা ন্যাড়া অবস্থায়। তাঁর আগমনে চিমটার (খঞ্জনি) মাথায় থাকা ধাতব চুড়ির আওয়াজ নাকি অনেকে শুনতে পেত। সন্ন্যাসীর ভয়ে রাত্রে স্ত্রী লোকদের বাড়ির বাইরে বা বাড়ির উপর কোঠায় শোওয়া নিষিদ্ধ ছিল।

জমিদার গোষ্ঠীর খামার থেকে অপর গোষ্ঠীর কূলদেবতা বাঁইড়্যা নাকি একবার ধন ( শস্য ) চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় সন্ন্যাসী ঠাকুর নাকি বাঁইড়্যাকে মারধর করে হৃতধনের পুনরুদ্ধার করেন।

তবে অপরগোষ্ঠী বাউড়ির দিন অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির আগের দিন রাত্রে বাঁইড়্যা ভূতের পূজা দেন। বাঁইড়্যা ভূতের সন্তুষ্টিতে তাদের শস্য উৎপাদন ভালো হয়; ধন-সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে এবং সংসারে শান্তি বজায় থাকে।

কাহিনিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য :

সন্ন্যাসী ঠাকুর ও বাঁইড়্যা ভূতের কাহিনিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হিসাবে বলা যেতে পারে, এখানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও  অহংবোধের পরিচয় ফুটে উঠেছে। সংস্কারাচ্ছন্ন দুই গোষ্ঠীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখানে সন্ন্যাসী ঠাকুর ও বাঁইড়া ভূতের দ্বন্দ্বের রূপকে প্রকাশিত ‌‌হয়েছে।

সন্ন্যাসী ঠাকুর, কুদরা ভুত, বাঁইড়্যা ভূত ছাড়াও গোঁসাই রায়, গাঁ- গরাম, ভান সিং (ভানুসিংহ অর্থাৎ সূর্য ঠাকুর), মোহনগিরি, রাঙাহাড়ি, বিশায়চন্ডী, পারগণা প্রভৃতি লৌকিক দেব-দেবীর পূজা- অর্চনা ও প্রভাব বিষয়ে কৃষক সমাজে নানা ধরনের লোকবিশ্বাস ও মিথ (myth) গড়ে উঠেছে।

আধুনিক সভ্যতার সর্বগ্রাসী প্রভাবে লোকসংস্কৃতির অন্যান্য আঙ্গিকের মত এই আঙ্গিকটিও ক্রমশ লোকসমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই রাত কহনিগুলি লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। এগুলির চর্চা এবং অস্তিত্ব রক্ষা মানব সমাজের পক্ষেই মঙ্গলজনক। কারণ এগুলি শিশু মনের কল্পনাশক্তির বিকাশে খুবই সহায়ক। বিশেষত বর্তমান প্রজন্ম এর কিশোর কিশোরীরা যেভাবে মোবাইল ফোন ও আধুনিক বিনোদনে মগ্ন হয়ে পড়ছে সেখানে এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। 

খবরটি শেয়ার করুণ

1 thought on “মানভূমে প্রচলিত রাত কহনি”

  1. Pingback: Manbhum Sanskriti: মানভূমের কৃষিকেন্দ্রিক ব্যঙ্গাত্মক প্রবাদ - উত্তরাপথ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


লোকসংস্কৃতির আলোকে মালদার শতাব্দী প্রাচীন গম্ভীরা  

মৈত্রেয়ী চৌধুরীঃ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের একটি জেলা মালদা। আমের জন্য এই জেলাটি পরিচিতি লাভ করলেও এই জেলা আর ও একটি কারণে বিখ্যাত, তা হল গম্ভীরা । মালদার নিজস্ব লোকসংস্কৃতি।গম্ভীরা শব্দটি প্রকোষ্ট, গৃহ বা মন্দির অর্থের সঙ্গে আভিধানিক মিল থাকলেও এই অনুষ্ঠানটি উন্মুক্ত আকাশের নিচে বা কোথাও চাঁদোয়া বা ত্রিপল  দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলেন স্বয়ং দেবাদিদেব। এই উৎসবের তিনি 'নানা' নামে পরিচিত।একজন শিবের সাজে থাকেন, আর দেবাদিদেবের চেলার মতো কিছু সংখ্যক সেই নানার ভক্ত হয়ে খোল, করতাল হাতে উনার সঙ্গী হন। বাস্তব জগতের এবং পারিপার্শ্বিক যা মা সমস্যা থাকে তা  চেলার নানার কাছে অভিযোগ জানান, যেন নানা সেই অভিযোগ শুনে তার সমাধান করেন।শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই ভিড় করে জমায়েত .....বিস্তারিত পড়ুন

বৈধ নথি ছাড়া প্লেনে ওঠার চেষ্টা এটি কি নিছক কৌতুহল মেটানো

উত্তরাপথঃ এটি কি নিছক কৌতুহল না কি কিশোর দুস্ক্রিয়তা। সম্প্রতি বাংলাদেশ এর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাসপোর্ট, টিকিট বা বোর্ডিং পাশ কোনও কিছু ছাড়াই জুনায়েদ নামের ১২ বছরের এক শিশু বৈধ নথি ছাড়া বিনা বাধায় কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়ে। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্লেনে চড়তে ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। এবার কৌশল পালটে বিমানবন্দরে ঢোকে শিশুটি। এ ঘটনায় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি বিভাগের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শাতে বলা  হয়েছে। গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। যে এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে, সেই কুয়েত এয়ারলাইন্সকেও শোকজ করা হয়েছে।  বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেছেন, ছেলেটি ব্রোকেন ফ্যামেলি .....বিস্তারিত পড়ুন

চম্পারন মাটন রাজনীতি কি কোনও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে

উত্তরাপথঃ সামনে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন ,আর সেই নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে INDIAজোট। মুম্বাইতে বিরোধী INDIA জোটের (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) তৃতীয় বৈঠকের একদিন পরে, কংগ্রেস শনিবার রাহুল গান্ধীর লালু প্রসাদ যাদব এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দিল্লিতে দেখা করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে তাদের চম্পারন মাটন দিয়ে রান্না এবং রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্যও মাটন চাইছেন যা প্রিয়াঙ্কা বাড়িতে উপভোগ করেন এবং সন্দেহ করেছিলেন যে রাহুল সত্যিই মাটন রান্না করেছেন কিনা। "সবাই করেছে। আমি রান্না করেছি, লালুজি রান্না করেছে, মিসা রান্না করেছে," রাহুল বলল। .....বিস্তারিত পড়ুন

আগামী ৩ বছরে শূন্য বর্জ্য হওয়ার পথে রাজস্থানের প্রথম গ্রাম

উত্তরাপথঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের আওতায় আঁধি গ্রামে এই পরিবর্তন করা হচ্ছে।জয়পুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আন্ধি গ্রাম।আগামী তিন বছরে এই গ্রাম শূন্য বর্জ্য হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ।আন্ধি গ্রামের এই সম্পূর্ণ রূপান্তরটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের অধীনে করা হচ্ছে।  এই প্রকল্পটি সবুজ প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ ব্যবহার করে আন্ধি গ্রামকে জিরো ওয়েস্ট মডেলে রূপান্তরিত করার কাজ চলছে ।  এই প্রকল্পটি ২১ মার্চ ২০২২ এ শুরু হয়েছে,  প্রকল্প পরিচালক বলেন, এ গ্রামের অবস্থা আগে খুবই খারাপ ছিল।আগে এই গ্রামের লোকেদের কঠিন বর্জ্য আলাদা করার কোনও ধারনা ছিল না । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top