মাইক্রোপ্লাস্টিক কি হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ? কি বলছে বিজ্ঞানীরা

উত্তরাপথঃসম্প্রতি নতুন একটি গবেষণায় মাইক্রোপ্লাস্টিককে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।গবেষকরা ৭ মার্চ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে উল্লেখ করেছেন যে ২৫৭ জন রোগীর প্লাক ব্লকিং ধমনীগুলির বিশ্লেষণে দেখা গেছে ধমনীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

 বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্লাস্টিকের প্রভাব সম্পর্কে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।ফুসফুস, লিভার এবং রক্ত ​​সহ আমাদের দেহের টিস্যুতে মাইক্রোস্কোপিক প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে যা নিঃসন্দেহে একটি চিন্তার বিষয়। কিন্তু মাইক্রো এবং ন্যানোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত এই কণাগুলি আসলে মানুষের ক্ষতি করে কিনা বা কতটা ক্ষতি করে সেই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি উত্তর এখনও বিজানীদের থেকে পাওয়া যায়নি।তবে বিজ্ঞানীদের মতে “আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে গণ হিস্টিরিয়া না হয়।”

 প্লাস্টিক সর্বত্র রয়েছে এবং তা অনেক পথ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। প্লাস্টিকের খেলনা, পাইপ, খাবারের পাত্র এবং অন্যান্য জিনিষপত্রগুলি যখন অনিবার্যভাবে সময়ের সাথে ভেঙে যায়, তখন তারা আমাদের পরিবেশে ক্ষুদ্র কণা ছেড়ে দিতে থাকে।বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছেন যে এই প্লাস্টিকের টুকরোগুলি কতটা ব্যাপকভাবে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।সমুদ্রের গভীরতা থেকে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত এমনকি চরম স্থানেও কণাগুলি দৃশ্যমান।  মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট (একটি গোলমরিচের আকৃতির সমান) এবং ন্যানোপ্লাস্টিক, যা প্রায় পাঁচ-হাজার রকম আকারের হয়ে থাকে ।প্ল্যাস্টিকের এই মাইক্রো কণাগুলি  আমাদের জলে প্রবেশ করতে পারে, মাটিতে জমা হতে পারে এবং বাতাসের সাথে প্রবাহিত হতে পারে।

 প্লাস্টিক দূষণের এই কণাগুলি আমাদের শরীরে খাদ্য ও পানীয়, আমরা যে বায়ু শ্বাস নিই এবং এমনকি সরাসরি ত্বকের মাধ্যমেও প্রবেশ করতে পারে। ইকোটক্সিকোলজিস্ট ম্যাথিউ ক্যাম্পেনের মতে , মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে আমাদের এক্সপোজার দিন প্রতিদিন আরও বাড়বে, কারণ একদিকে পুরাতন প্লাস্টিকগুলি  ক্ষয় হয়ে পরিবেশে প্রবেশ করছে অন্যদিকে নতুন প্লাস্টিকের উৎপাদন দিন প্রতিদিন আরও বাড়ছে। ফেব্রুয়ারী মাসে, আলবুকার্কের নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পেইন টিম রিপোর্ট করেছে যে ৬২ টি মানুষের প্লাসেন্টা নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে,এবং সমস্ত নমুনাতে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। অর্থাৎ মানব মস্তিষ্ক এবং টেস্টিকুলার টিস্যুতেও প্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে।

 বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা প্লাস্টিক কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে তার একটি দ্রুত উদীয়মান চিত্র প্রকাশ করে।বিজ্ঞানীরা ক্যারোটিড ধমনী, ঘাড়ের রক্তনালীগুলি যা মস্তিষ্কে রক্ত ​​​​বহন করে তা পরিষ্কার করার জন্য অস্ত্রোপচার করা রোগীদের থেকে ধমনীর নমুনা পরীক্ষা করেছেন।  মিলানের IRCCS মাল্টিমেডিকার কার্ডিওভাসকুলার গবেষক ফ্রান্সেস্কো প্রাতিচিজ্জো বলেছেন, “আমরা দেখতে পেয়েছি যে অর্ধেকেরও বেশি রোগীর দেহে অন্তত এক ধরনের প্লাস্টিকের উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে।”

এখন প্রশ্ন ধমনীর মাইক্রোপ্লাস্টিক হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে কিনা? এর জবাবে প্রাতিচিজ্জো বলেছেন, এটা সম্ভব যে ধমনীর ভিতরে প্লাস্টিক প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগকে আরও বাড়িয়ে দেয়।  উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিক-বোঝাই ধমনীতে প্লাস্টিক-মুক্ত ধমনীর চেয়ে বেশি প্রদাহজনক অণু রয়েছে। প্রাতিচিজ্জো বলেন, গবেষকরা এখনও প্রমাণ করেননি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্ষতিকর।তবে তারা মানুষের শরীর এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের খারাপ ফলাফলের মধ্যে একটি লিঙ্ক উন্মোচন করেছে।

 নেদারল্যান্ডসের উট্রেখ্ট ইউনিভার্সিটির টক্সিকোলজিস্ট জুলিয়েট লেগলারের মতে, প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা করা খুবই কঠিন।পরিবেশে ভাসমান কণাগুলি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় গবেষকের গ্লাভসে করে যেতে পারে।গবেষণাগারে প্লাস্টিক সর্বত্র রয়েছে।সার্জিক্যাল ইউনিট থেকে হাসপাতাল সর্বত্রই প্লাস্টিক রয়েছে।সেক্ষেত্রে নমুনাগুলির দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। প্রাতিচিজ্জো ও তার দল তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তুলার গ্লাভস এবং কাচের পাত্র ব্যবহার করেছিল । প্রাতিচিজ্জো র মতে “আমরা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতে পারি না যে সম্ভাব্য দূষণ ছিল।” 

প্রাতিচিজোর দলের ফলাফল হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ খোঁজার ক্ষেত্রে একটি সতর্কতা।মানুষের অযথা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয় – কিন্তু প্লাস্টিক ব্যবহার রোধ করার জন্য যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার।

সূত্রঃ The New England Journal of Medicine. Published online March 7, 2024. এবং Toxicology Sciences. Published online February 17, 2024.

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top