রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় বাংলাদেশ

প্রীতি গুপ্তাঃরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিদের জন্য সাহিত্যিক মহত্ত্বের শিখর হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা বাঙালীর গর্ব, আনন্দ, সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণার উৎস যা জীবনের সমস্ত দিককে ছুঁয়ে গেছে, অনেকটা ইংরেজদের জন্য শেক্সপিয়ার, ফরাসিদের জন্য ভিক্টর হুগো, জার্মানদের জন্য গ্যেটে, ইতালীয়দের জন্য দান্তে, রাশিয়ানদের জন্য টলস্টয়, উর্দুভাষীদের জন্য গালিব, পারসিকদের জন্য ফেরদৌসি এবং সংস্কৃত অনুরাগীদের জন্য কালিদাসের মতো।

বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আইকন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পালিত হয় তা নয়, পিছিয়ে নেই প্রতিবেশী বাংলাদেশও।ভারতের মতোই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।বাংলাদেশের অনেক জায়গার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে কবির স্মৃতিচিহ্ন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়ি, শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের পতিসর, নওগার কুঠিবাড়ি ও খুলনার কুঠিবাড়ি ও কবির শ্বশুরবাড়ি তারমধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের খুলনা জেলার রূপসা থানার পিঠাভোগেই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বসবাস। পরবর্তীকালে তাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। কলকাতার জোড়াসাঁকোয় ১৮৬১ সালের ৭ মে কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের সারদা দেবীকে। ১৮৮৩ সালে কবির সাথেও বাংলাদেশের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা মৃণালিনী দেবীর বিয়ে হয়। এভাবে আত্মীয়তার নিগূঢ় বন্ধনে কবি আবদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে।

 ১৮৯৮ সাল থেকে কবি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে শিলাইদহে বাস করেন।পরবর্তীতে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরলেও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়নি কখনও।১৮৮৮ সাল থেকে ১৯১৫ এই সময়ে বহুবার পূর্ববঙ্গে আসেন রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন অগণিত দিন। । ঢাকায় এসেছেন দুবার একবার ১৮৯৮ সালে, অন্যবার ১৯২৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ শেষবার বাংলাদেশে আসেন ১৯৩৭ সালে পুণ্যাহ উৎসব উপলক্ষে। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট্, উপাধি দেয়, তিনি অবশ্য নিজে এসে তা গ্রহণ করতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয়ের মধ্যে কলকাতা ও পূর্ব বাংলার ঐক্য ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি উভয় অঞ্চলকেই একীভূত বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেছিলেন, এরই অঙ্গ হিসেবে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি তার তীব্র বিরোধ ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি “আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনা করছিলেন।

১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত এই সময়টি, কবির ‘সাধনা কাল’ নামে পরিচিত।এই সময়টিকে কবির সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে একটি শীর্ষ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।কবিগুরু এই সময়টিতে তার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ এবং সৃজনশীল রচনায় লিপ্ত থেকেছেন যা আগে কখনো হয়নি।এই রূপান্তরকালীন সময়ে, ঠাকুর বিখ্যাত সংকলন গল্পগুচ্ছের উল্লেখযোগ্য অংশ সহ অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং চিঠি লিখেছিলেন। এই সময়ের গল্পগুলি পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামের উপর আলোকপাত করেছে, যারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। কবির রচনায় এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রাণবন্ত সংস্কৃতির বর্ণনা করা হয়েছে।

তবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশে যে বিতর্ক হয়নি, এমনটাও বলা যাবে না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বড়রকম বিতর্ক দেখা দিয়েছিল ১৯৬১ সালে।সেই সময়  পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা স্বদেশে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের আয়োজন করতে দিতে চাননি। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতরূপে এটি গৃহীত হয়। আজও বাংলাদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে শিক্ষালাভ করতে আসেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজেদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


কার্বন নিঃসরণ দ্রুত শেষ করার জন্য G7 ঐক্যমত

উত্তরাপথ: বিশ্বের সাতটি ধনী দেশের শক্তি ও পরিবেশ মন্ত্রীরা সম্প্রতি  জ্বালানি এবং পরিবেশগত ইস্যুতে উত্তর জাপানের শহর সাপোরোতে বৈঠক করেন।  G-7 বৈঠকে জড়ো হওয়া বিভিন্ন দেশের আধিকারিকরা তাদের প্রতিশ্রুতির রূপরেখা দিয়ে একটি কমিউনিক জারি করেছে। বৈঠকে বর্তমান সঞ্চিত জ্বালানি সংকট এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমান গুরুত্ব দিয়ে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG) নির্গমনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সমস্ত নেতারা দক্ষ, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং দূষণ মুক্ত শক্তির উৎস সন্ধানের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগেও .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রয়াত "কালবেলা"-র স্রষ্টা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার

উত্তরাপথ: সাহিত্য একাডেমি পুরুষ্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার কলকাতার এক বেসরকারী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রামণের কারনে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম এই বিখ্যাত লেখকের।ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা (সাম্মানিক) স্নাতক বিভাগে৷ এর পর স্নাতকোত্তর  সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য .....বিস্তারিত পড়ুন

রাহুলের ভারতজোড় সাফল্য পেলেও, অভিষেক কি পারবে ?

উত্তরাপথ: রাহুল গান্ধীর ১৪৬ দিনের প্রায় ৩৮৫০ কিলোমিটার ভারতজোড় যাত্রার সাফল্য কংগ্রেস ঘরে তুলতেই তৃনমূলের নতুন উদ্যোগ জনসংযোগ যাত্রা।এই যাত্রায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৬০ দিনে ৩,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ " জনসংযোগ " করবেন। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা রাজ্যের সবচেয়ে দক্ষিণ প্রান্ত দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে শেষ হবে। এই পুরো যাত্রায় অভিষেক মোট ২৫০টি সমাবেশে ভাষণ দেবেন। এখন প্রশ্ন তৃণমূল তথা অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর ভারতজোড় যাত্রার উদ্দেশ্য .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top