Demonic Black Holes: রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল

J0529-4351 ব্ল্যাক হোল-এর অবস্থান এবং তার চারপাশের ছবি| ছবিটি নেওয়া হয়েছে @VVVScienceTeam নামক X-Handle থেকে |

ড. সায়ন বসু: “ছিল রুমাল, হয়ে গেলো বেড়াল”- এত বছর ধরে যাকে ভেবে আসা হয়েছিল একটি সাধারণ তারা সেই কিনা অবশেষে চিহ্নিত হলো এক রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল হিসেবে !

পৃথিবী থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের সন্ধান দিয়েছেন ৮ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর একটি দল| গবেষণাপত্রটি এবছর নেচার অ্যাস্ট্রোনমির ১৯শে ফেব্রুয়ারীর সংখ্যায়  প্রকাশিত হয়েছে| এই গবেষণাটির পুরোভাগে আছেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর Christian Wolf | তাদের দাবি অনুযায়ী J0529-4351 হলো এখনও অব্দি  এই মহাবিশ্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সব থেকে উজ্বলতম বস্তু| গবেষকরা এও দাবি করেছেন যে এই ব্ল্যাক হোলটি তৈরী হয়েছে বিগ ব্যাং-এর মাত্র ১.৫ বিলিয়ন বছর পরে| জ্যোতির্বিজ্ঞানের সময়কাল হিসেবে অনুযায়ী বলাই যায় যে এটি এখনও “তরুণ” অবস্থায় আছে! মজার কথা এই যে, ১৯৮০ সালে European Southern Observatory এই J0529-4351-কে চিহ্নিত করে কিন্তু অতি উজ্জ্বলতার কারণে এটিকে সেসময় একটি তারা হিসেবে মনে করা হয়| 

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন রকমের নিরীক্ষণের মাধ্যমে প্রায় ১ মিলিয়ন ব্ল্যাক হোল খুঁজে পেয়েছেন যেগুলি বেশ তাড়াতাড়ি আকারে বাড়ছে! এখানে বলে রাখা ভালো, ব্ল্যাক হোল, ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থান করে এবং এদের “শিকার” সাধারণত এর আশেপাশে থাকা তারা এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম| ব্ল্যাক হোল তার চারপাশে থাকা তারা এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমকে নিজের দিকে টানতে থাকে এবং এগুলি যখন ব্ল্যাক হোলের কাছে চলে আসে তখন প্রচন্ড বেগে ঘুরতে থাকে তার চারপাশে | এর ফলে যে একটি ঘুরন্ত চাকতির মতো অংশ তৈরী হয় তাকেই বলে অ্যাক্রেশন ডিস্ক (accretion disc) | এই অ্যাক্রেশন ডিস্ক দেখতে অনেকটা শনির বলয়ের মতো| এই অ্যাক্রেশন ডিস্ক অঞ্চলে কোন বস্তুর পড়ে যাওয়ার অর্থ হলো তা ব্ল্যাক হোল-এ পড়বেই| এই অ্যাক্রেশন ডিস্কে থাকা তারা এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম যেহেতু প্রচন্ড বেগে ঘুরতে থাকে তাই সাধারণ ভাবেই তাদের মধ্যে ঘর্ষণ শুরু হয় এবং এর ফলে প্রচন্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে যে উজ্জ্বলতা দেখা যায় অনেক সময় তা ছায়াপথের উজ্জ্বলতাকেও ঢেকে দেয়| ব্ল্যাক হোল-এর দিকে তারা এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম এগুলি যতো এগোতে থাকে ততো তাদের গতিবেগও বাড়তে থাকে| একটা সময় এই গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১০,০০০ কিলোমিটার অব্দিও পৌঁছাতে পারে! 

J0529-4351 ব্ল্যাক হোল-এর অ্যাক্রেশন ডিস্কটির ব্যাস প্রায় ৭ আলোকবর্ষ এবং এই অ্যাক্রেশন ডিস্কটি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সব থেকে বড়| প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে  J0529-4351 এর  অ্যাক্রেশন ডিস্ক থেকে যে পরিমান আলো বেরিয়ে আসে তা আমাদের সূর্যের থেকে প্রায় ৫০০ ট্রিলিয়ন গুন বেশি! এবং গবেষকরা দাবি করেছেন যে এই পরিমান আলো তখনই বিচ্ছুরিত হতে পারে যদি এই ব্ল্যাক হোল প্রতিদিন আমাদের সূর্যের সমপরিমান উপাদান রোজ “খেতে” থাকে! গবেষকরা আরো উল্লেখ করেছেন যে তাদের মতে এই ব্ল্যাক হোলের ওজন ১৫ – ২০ বিলিয়ন সূর্যের ওজনের সমান| এই রকম মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া তথ্য পড়ে ভয় খাওয়ার কিছু নেই কারণ এই রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসতে মোটামুটি ১২ বিলিয়ন বছর লাগবে| এখানে এও বলে রাখা ভালো যে বর্তমান গবেষণা অনুযায়ী আমাদের কাছাকাছি যে সমস্ত ছায়াপথ আছে, তাদের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাক হোলগুলিকে আপাতভাবে “ঘুমন্ত দৈত্য” বললেও অত্যুক্তি হবে না|

এই ব্ল্যাক হোলটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ Siding Spring Observatory-তে অবস্থিত টেলিস্কোপের সাহায্যে চিহ্নিত করেন এবং এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে তারা সাহায্য নেন চিলিতে অবস্থিত European Southern Observatory-র Very Large Telescope-এর যা কিনা এই মূহুর্তে বিশ্বের বড় টেলিস্কোপগুলির মধ্যে অন্যতম| Very Large Telescope বা VLT-তে চারটি টেলিস্কোপ আছে যেগুলির এক একটির ব্যাস ৮ মিটার| আপাতত এই ব্ল্যাক হোল-এর সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও আরোও অনেক কিছুই অজানা আমাদের কাছে| যেমন এই ব্ল্যাক হোলটির এতো “ক্ষিদের” কারণ কি বা যে ছায়াপথের কেন্দ্রে এটি অবস্থিত তার মধ্যে তারা এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম-এর গতিবিধিই বা কেমন| এইসব কিছু জানতে গেলে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে আরোও শক্তিশালী টেলিস্কোপ-এর দিকে যার মধ্যে অন্যতম চিলিতে অবস্থিত Atacama Large Millimeter/Submillimeter Array |

বোঝার সুবিধার জন্যে এই লেখার মধ্যে ব্যবহূত বেশ কিছু একক-এর বিবরণ:

১ আলোকবর্ষ : আলো এক বছরে যত পরিমান পথ অতিক্রম করে| ১ আলোকবর্ষ = ৯৫ হাজার কোটি কিলোমিটার |

১ মিলিয়ন : ১০ লক্ষ

১ বিলিয়ন : ১০০০ মিলিয়ন

১ ট্রিলিয়ন : ১০০০ বিলিয়ন

চিলিতে অবস্থিত Very Large Telescope-এর অন্তর্গত টেলিস্কোপগুলির ছবি| ছবিটি @Ruudess নামক X-handle থেকে সংগৃহীত|

** লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand বিশ্ববিদ্যালয়ে School of Physics-এ কর্মরত |

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে

উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top