মহাকাশের রানার “OSIRIS-REx”

বেণু থেকে সংগৃহীত নমুনাটি যে ধারকের মধ্যে রাখা ছিল সেটি বিজ্ঞানীরা খুলছেন নাসার জনসন মহাকাশ কেন্দ্রে| ছবিটি NASA Solar System নামক X হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত |

ড. সায়ন বসু: রানার যেমন আগেকার দিনে একগ্রাম থেকে অন্যগ্রামে দৌড়ে দৌড়ে খবর পৌঁছে দিতো তেমনই মহাকাশে এক রানার বর্তমানে এক গ্রহাণু থেকে অন্য গ্রহাণু ঘুরে ঘুরে আমাদের কাছে নতুন নতুন তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত| আজকের লেখা তেমনই এক রানার থুড়ি একটি মিশনকে নিয়ে যার নাম OSIRIS-REx।

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দিনটি আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে থেকে যাবে।এই দিন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র NASA থেকে পাঠানো OSIRIS-REx (Origins, Spectral Interpretation, Resource Identification, Security, Regolith Explorer) নামক মিশনের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে প্রায় ১৯ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রহাণু বেনু (Bennu) থেকে ২৫০ গ্রাম বা তার থেকে একটু বেশি পরিমান নমুনা নিয়ে আসা হয়েছে।গ্রহাণুর নমুনাটি নিয়ে একটি স্পেস ক্যাপসুল আমেরিকার ঊতাহ প্রদেশের উত্তরভাগের মরুভূমি অঞ্চলে অবতরণ করে এবং সেটিকে নিয়ে একটি বিমান ২৫ সেপ্টেম্বর হিউস্টন-এর উদ্দেশ্যে রওনা হয় যেখানে এই নমুনাটিকে নাসার জনসন মহাকাশ কেন্দ্রে রেখে দেওয়া হবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে।এখানে উল্লেখ করে রাখা উচিত যে এই মিশনটির জন্যে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তার পরিমাণ প্রায় ১.১৬ বিলিয়ন ডলার। 

OSIRIS-REx এই মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে।২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে পৃথিবীর চক্কর কাটার পর (যা কিনা তার গতিবেগ বাড়াতে সাহায্য করে) সেটি উড়ে যায় নিজের গন্তব্যের দিকে এবং ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে পৌঁছায় বেনু নামক গ্রহাণুর কাছে।মহাকাশ বিজ্ঞানীরা প্রায় দু’বছর ধরে এই গ্রহাণুটিকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার পরে সিদ্ধান্ত নেন যে OSIRIS-র মাধ্যমে বেনু থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হবে এবং তা ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে পৃথিবীতে এবং OSIRIS পাড়ি দেবে নিজের পরবর্তী গন্তব্যে। সেই অনুযায়ী ২১ অক্টোবর ২০২০ সালে বেনুর একটি পাথুরে অংশ যার নামকরন করা হয়েছিল Nightingale সেখানে OSIRIS পৌঁছায় এবং Touch-And-Go Sample Acquisition Mechanism (TAGSAM) এর মাধ্যমে পাথুরে অংশের ওপর বিশুদ্ধ নাইট্রোজেন গ্যাস প্রয়োগ করে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অবশেষে সেই বিস্ফোরণ থেকে উঠে আসা প্রায় ২৫০ গ্রাম ওজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়| এই নমুনা নিয়ে OSIRIS পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রওনা হয় ১০ মে ২০২১ সালে।OSIRIS-REx মিশনের উদ্দেশ্য ছিল বেনুর নমুনাটিকে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরবর্তী গ্রহাণু এপফিস (Apophis)-এর দিকে পাড়ি দেওয়া যেখানে সে পৌঁছাবে ২০২৯ নাগাদ| মিশনের এই পর্যায়ের নাম ঠিক করা হয়েছে OSIRIS-APEX (Apophis Explorer)।

এ তো গেলো OSIRIS-REx এর কথা এবার আসা যাক বেনুর কথায়| বেনু নামক গ্রহাণুটির পূর্ববর্তী নাম ছিল 1999 RQ36। ২০১৩ সালের একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৯ বছর বয়সী মাইক পুযিও (Mike Puzio) এর নামকরণ করে বেনু।বেনু হলো মিশরীয় দেবতা যাকে ধূসর রঙের সারস জাতীয় পাখি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এই গ্রহাণুটি আকারে প্রায় ৫০০ মিটার চওড়া যা কিনা আমেরিকার বিখ্যাত Empire State Building বা ফ্রান্সের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার দুটির থেকেও আরো বড়। পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে প্রায় ১৯ কোটি কিলোমিটার দূরে যে সমস্ত গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে বেণুও তাদের মধ্যে একটি| প্রায় ২০০র কাছাকাছি গ্রহাণু যাদের কক্ষপথ বেশ ভালো ভাবে বিজ্ঞানীদের জানা তাদের মধ্যে বেনু হলো অন্যতম এবং এটির কক্ষপথের সাথে পৃথিবীর কক্ষপথের বেশ মিলও আছে| সূর্যের চারিদিকে ঘুরতে পৃথিবীর যেমন ৩৬৫ দিন (লিপ ইয়ার হলে ৩৬৬ দিন) লাগে তেমনই বেনুর লাগে ৪৩৬ দিন এবং প্রতি ৬ বছর অন্তর এটি পৃথিবীর বেশ কাছেও চলে আসে।

নাসার OSIRIS-REx মিশনের মাধ্যমে বেণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে স্পেস ক্যাপসুলটি আমেরিকার ঊতাহ প্রদেশের মরুভূমিতে অবতরণ করে | ছবিটি NASA Solar System নামক X হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত ।

মহাকাশবিজ্ঞানীদের মতে যে সমস্ত গ্রহাণুর আকার ২০০ মিটারের থেকে কম সেগুলির ঘূর্ণন গতি বেশি হওয়ার ফলে যেকোনো মহাকাশযানের পক্ষে অবতরণ করা প্রায় অসম্ভব। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বেনুর আকার বেশ কিছুটা বড় হওয়ার ফলে সেই অসুবিধা নেই সাথে বিজ্ঞানীরা বেনুর গঠন নিয়েও বেশ আশাবাদী কারণ এটির মধ্যে আছে বহুল পরিমানে কার্বনজাত উপাদান।বিজ্ঞানীরা মনে করেন ঠিক এমন গঠনযুক্ত কোনো গ্রহাণুই হয়তো পৃথিবীর বুকে জল এবং তার সাথে জীবন বিকাশের জন্যে যে সমস্ত উপাদান লাগে সেসব নিয়ে এসেছিলো| সেদিক থেকে দেখতে গেলে বেনুর বুকে OSIRIS এর এই অভিযান সত্যিই যুগান্তকারী। 

বেনুর মধ্যে এতো গুণ থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার জন্যে এটিকে একটি বিপদজনক গ্রহাণু হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে অনুযায়ী ২৩০০ সাল অব্দি পৃথিবীর ওপর বেনুর আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা ১৭৫০ বারের মধ্যে একবার।এবং যদি এই আছড়ে পরেও তাহলে তার প্রভাব পৃথিবীর ওপর সেই ভাবে পড়বে না যাতে করে বলা যায় যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।বরং বলা যায় যেখানে এটি আছড়ে পড়বে সেই জায়গা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি হবে। 

OSIRIS-REx এর মাধ্যমে তোলা বেণুর একটি ছবি| এটি তোলা হয় ৪ মার্চ ২০২১ সালে | ছবিটি বেণু থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে তোলা| ছবিটি NASA’s OSIRIS-REx নামক X হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত ।

এই লেখা যখন আপনারা পড়ছেন তখন ইতিমধ্যেই সেই স্পেস ক্যাপসুলের মধ্যে থেকে গ্রহাণুর নমুনাটি যে কৌটোর মধ্যে রাখা ছিল সেটিকে খোলা হয়ে গেছে এবং বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। নাসা কর্তৃপক্ষ ১১ই অক্টোবর একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যেখানে OSIRIS-REx এর মাধ্যমে গ্রহাণু বেনু থেকে সংগৃহিত নমুনা সম্বন্ধে আরোও বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।

OSIRIS-REx তোলা গ্রহাণু বেণুর ছবি | ছবিটি X-হ্যান্ডল থেকে গৃহীত ।

* লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক ।

যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za

* নাসার OSIRIS-REx মিশনের সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্যে নিচের লিংকটি ব্যবহার করতে পারেন : https://science.nasa.gov/mission/osiris-rex

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


চম্পারন মাটন রাজনীতি কি কোনও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে

উত্তরাপথঃ সামনে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন ,আর সেই নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে INDIAজোট। মুম্বাইতে বিরোধী INDIA জোটের (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) তৃতীয় বৈঠকের একদিন পরে, কংগ্রেস শনিবার রাহুল গান্ধীর লালু প্রসাদ যাদব এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দিল্লিতে দেখা করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে তাদের চম্পারন মাটন দিয়ে রান্না এবং রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্যও মাটন চাইছেন যা প্রিয়াঙ্কা বাড়িতে উপভোগ করেন এবং সন্দেহ করেছিলেন যে রাহুল সত্যিই মাটন রান্না করেছেন কিনা। "সবাই করেছে। আমি রান্না করেছি, লালুজি রান্না করেছে, মিসা রান্না করেছে," রাহুল বলল। .....বিস্তারিত পড়ুন

ভোরের শুকতারা

অনসূয়া পাঠকঃ বাস ছাড়তে তখনো কিছুটা সময় বাকি ছিলো, আমি মা বাবার সাথে বাসের ভেতরে জানালার দিকের সিটটায় বসে আছি। এমন সময় দেখি আমাদের পাশের সিটে বসে একজন রবীন্দ্রনাথের সঞ্জয়িতা পড়ছেন, বইটাকে দেখে আমার চোখের সামনে একটা সোনালী ফ্রেমের চশমা পরা মুখ ভেসে উঠলো, চন্দন স্যারের মুখ। বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার বাবা তখন জঙ্গলমহল মেদিনীপুরের আমলাশুলির পোষ্টমাষ্টার। দু কিমি দূরেই আমার পিসীমার বাড়ি। ওখানেই আমার হাইস্কুলে পড়াশোনা শুরু। আর যে স্যার আমার মননে সদা জাগরুক , বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ বলা যায় যাকে , আমার গল্প যাঁকে নিয়ে সেই চন্দন স্যারকে ওখানেই পাওয়া। ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় ক়াঁচা পাকা চুল , সরু গোঁফ চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, .....বিস্তারিত পড়ুন

শূন্য বর্জ্য নীতি গ্রহনে জাপান আজ বিশ্বগুরু

উত্তরাপথঃ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ শহর জাপান । সম্প্রতি তার শূন্য বর্জ্য নীতি-এর কারণে খবরের শিরোনামে । Zero Waste বা শূন্য বর্জ্য হল- অযথা খরচকে ন্যূনতম রেখে উৎপাদিত আবর্জনা কমানোর প্রচেষ্টা। ১৯৯৬ সালে , অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা বিশ্বের প্রথম শূন্য-বর্জ্য শহরের শিরোপা অর্জন করে।এরপর Zero Waste ধারণাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, উদাহরণস্বরূপ কানাডার টরন্টো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো নিজেদের শূন্য-বর্জ্য শহর হিসাবে ঘোষণা করে । পরিবেশ সচেতনতার ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের প্রায় ৭০% পৌরসভা নিজেদের শূন্য-বর্জ্য পৌরসভা হিসাবে ঘোষণা করেছে।এদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত, জাপানের পাঁচটি শহর নিজেদের শূন্য বর্জ্য শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে।জাপানের তোকুশিমা প্রিফেকচারের কামিকাতসু টাউন প্রথম নিজেদের শূন্য বর্জ্য  শহর হিসেবে ঘোষণা করার পর, ধারণাটি পুরো জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। .....বিস্তারিত পড়ুন

রাজা মহম্মদ ও সি সেল মিউজিয়াম

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ রাজা মহম্মদ, এমন একজন মানুষের নাম, যার ব্যাক্তিগত ইচ্ছার কাছে হেরে যায় সব বাধা। ইচ্ছার চেয়ে বলা ভালো নেশা। সামুদ্রিক প্রাণীদের খোল সংগ্রহের নেশা। যা তাঁকে ছোটবেলা থেকেই ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে প্রায় তিরিশ বছর ধরে। আর সেই দীর্ঘ পথের শেষে , তিনি সম্পূর্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এশিয়ার বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাক্তিগত সংগ্রহশালা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সি সেল মিউজিয়ামটি বর্তমানে চেন্নাইয়ের মহাবলিপূরম মন্দিরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। রাজা মহম্মদ ছোট্ট বেলা থেকেই  সমুদ্র তট থেকে সংগ্রহ করতেন বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাংশ। কুড্ডালোর থেকে রামেশ্বরম এর সমুদ্রতট, সেখান থেকে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশে গিয়েছেন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে। সংগ্রহ করেছেন অসাধারণ সব সামুদ্রিক .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top