Race for Resources: চাঁদ এবং বিভিন্ন গ্রহাণুকে নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা

সৌম্য সেনগুপ্তঃ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চাঁদ এবং গ্রহাণুর মতো মহাকাশীয় বস্তু থেকে খনিজ আমদানি (Race for Resources) নিয়ে আবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে।মহাকাশ থেকে খনিজ আমদানির ধারণাটি এক সময় কল্পকাহিনী মনে হলেও আজ সেটি বাস্তবতায় স্থানান্তরিত হয়েছে। ২০১৫ সালে, নাসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে চাঁদে “শত বিলিয়ন ডলার” অব্যবহৃত সম্পদ রয়েছে।আজ মূলত এই সম্পদগুলির জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে, যা বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে একটি নতুন মহাকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ইতিমধ্যেই আর্টেমিস ১ মিশন সম্পন্ন করেছে । নাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে  চাঁদে কলোনি তৈরি করার। চাঁদ জয়ের এই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া সম্প্রতি একটি অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। একই সময়ে সবচেয়ে কম খরচে চাঁদের বুকে অবতরণ করেছে ভারতের চন্দ্রযান ৩। জাপানও সাম্প্রতিক এক অভিযানে চাঁদের বুকে নিরাপদে অবতরণ করিয়েছে তাদের মুন স্নাইপার নভোযান।

চাঁদ জয়ের এই প্রতিযোগিতা এক কথায় Race for Resources যা এক সময় শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার হাত ধরে ১৯৬৯ সালে মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে পা রাখার মাধ্যমে।এতবছর পর চাঁদ জয়ের সেই প্রতিযোগিতা আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। এবারে আরও বড় পরিসরে, আরও বিপুলভাবে শুরু হয়েছে এই প্রচেষ্টা। এই প্রতিযোগিতায় শুধু চাঁদ নয়, বিভিন্ন গ্রহাণুতেও অভিযান চালাচ্ছে এখন দেশগুলো। সাইকি নামের একটি গ্রহাণুর উদ্দেশ্যে নভোযান পাঠিয়েছে সম্প্রতি নাসা। ওদিকে হায়াবুসা ২ গ্রহাণুতে অভিযান চালিয়েছে জাপান। লক্ষ্য একটিই স্পেস মাইনিং,আর তানিয়ে এই প্রতিযোগিতা। পৃথিবীতে সম্পদের অবক্ষয় হওয়ার সাথে সাথে, এবার দেশগুলির লক্ষ্য এবার মহাকাশের দিকে কারণ অনুমান করা হচ্ছে বিভিন্ন গ্রহাণুর খনিজ সম্পদের মূল্য ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে ৷

এখন প্রশ্ন হতেই পারে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহাণুতে ছড়িয়ে থাকা সম্পদের মালিকানা কার? ১৯৬৭ সালে ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়।এটি হল আনুষ্ঠানিকভাবে “চাঁদ এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তু সহ মহাকাশের অন্বেষণ এবং ব্যবহারে রাষ্ট্রগুলির কার্যক্রম পরিচালনার নীতির উপর আন্তর্জাতিক চুক্তি” যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল।এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলির মধ্যে Race for Resources কম করা।

এই মহাকাশ চুক্তির মূল বিধানগুলির মধ্যে রয়েছে:

১। মহাকাশে বিনামূল্যে যেকোনো দেশ অনুসন্ধান করতে পারবে কোনও জাতি মহাকাশ বা কোনও মহাকাশের উপর সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারবে না।

২। পৃথিবীর চারপাশে কক্ষপথে পারমাণবিক অস্ত্র বা গণবিধ্বংসী অন্যান্য অস্ত্র স্থাপন নিষিদ্ধ। কোনো রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র বা অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র মহাকাশে স্থাপন করতে পারবে না।

৩। রাষ্ট্রগুলি তাদের দেশের যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার দ্বারা মহাকাশ ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে এবং মহাকাশে দূষণ প্রতিরোধে সব রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।

৪। চাঁদ এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তু শুধু শান্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে।

৫। কোনো দেশের স্যাটেলাইটের কারণে মহাকাশে কোনো ক্ষতি হলে সেই দেশ দায়বদ্ধ থাকবে।

‘আউটার স্পেস চুক্তিটি’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সদস্যদের মতো প্রধান মহাকাশযান দেশগুলি সহ ১০০ টিরও বেশি দেশ দ্বারা স্বাক্ষরিত এবং অনুমোদিত হয়েছে।এ চুক্তি অনুযায়ী, কোনো দেশ চাঁদ বা মহাশূন্যের কোনো বস্তুর মালিকানা দাবি করতে পারবে না। পৃথিবীর বাইরের সব সম্পত্তির মালিক গোটা মানবজাতি।২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৩২ টি দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।মহাকাশ আইন বিশেজ্ঞদের প্রশ্ন, কোনো জাতি বা রাষ্ট্র যদি মহাকাশের মালিকানা দাবি করতে না পারে, তাহলে কোনো রাষ্ট্রের মানুষও মালিকানা দাবি করতে পারে না। কিন্তু তার পরও চলছে Race for Resources । আউটার স্পেস চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে ইউএস সিনেটে পাশ করেছে ‘স্পেস অ্যাক্ট’। এই আইনে বলা আছে, মার্কিন নাগরিকরা মহাকাশের বিভিন্ন সম্পদের মালিকানা দাবি করতে পারবেন। ওদিকে লুক্সেমবার্গ সরকার ২০১৭ সালে একটা আইন পাশ করেছে, যাতে তারা নিজ দেশের নাগরিকদের মহাজাগতিক বস্তু থেকে সম্পদ সংগ্রহ ও মালিকানাধীন রাখার অধিকার দিয়েছে। জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এর বিরুদ্ধে আপিল করলেও খুব একটা লাভ হয়নি তাতে। তবে বর্তমানে দেশগুলো চেষ্টা করছে মিলেমিশে একটা নীতিতে আসার।

NASA জল চাঁদে ছাড়াও হিলিয়াম -৩ অস্তিত্বের কথা বলেছে, যা পারমাণবিক সংমিশ্রণে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও ল্যান্থানাইড, স্ক্যান্ডিয়াম এবং ইট্রিয়ামের মতো বিরল আর্থ ধাতুগুলিও উল্লেখ করেছে, যা ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহৃত হয় এবং বেশিরভাগই চীনে উৎপাদিত হয়।চাঁদে যদি জল পাওয়া যায়, তবে চাঁদে কলোনি করা হয়ে যাবে অতি সহজ। অনেক সমস্যার সমাধান যেমন হবে, তেমনি এ থেকে রকেটের ফুয়েল (হাইড্রোজেননির্ভর জ্বালানি) বানানোও যাবে সহজে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিলিয়াম-৩। এটি নিত্যদিনের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় যেমন এমআরআই (MRI) মেশিনে। এই যন্ত্রের ভেতরে আছে শক্তিশালী চুম্বক। এই চুম্বককে প্রচণ্ড ঠান্ডা করতে—মাইনাস ২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়,যার জন্য দরকার হয় হিলিয়ামের। তবে এর আরও বড় ব্যবহার হবে আগামী দিনগুলোতে। অনেক বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী দিনে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দিকে এগোচ্ছি। আগামী ৫০ বছরে এই কম্পিউটার এসে যাবে সবার কাছে। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল চালিকা শক্তি যে কোয়ান্টাম প্রসেসর, তা কাজ করে কিউবিট দিয়ে। এই কিউবিটের কার্যক্রম বজায় রাখতে ও কোয়ান্টাম প্রসেসরকে সক্রিয় রাখতে হলে প্রচণ্ড ঠান্ডা রাখতে হয়। এ জন্য, বলা বাহুল্য, হিলিয়াম লাগবে। পাশাপাশি শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে, যেমন নিউক্লিয়ার ফিউশনে লাগবে হিলিয়াম। আর বর্তমানে পৃথিবীতে হিলিয়ামের মজুদ খুব কম, ফুরিয়ে আসছে দিন দিন। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে চাঁদ।

 অন্যদিকে  ল্যান্থানাইড সিরিজের মৌলগুলো এবং স্ক্যান্ডিয়াম, ইট্রিয়ামের মতো পদার্থ রয়েছে চাঁদে। এগুলোর ব্যবহার রয়েছে আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে। বিশেষ করে বর্তমানে চীন যেসব প্রযুক্তি নির্মাণ করছে, সেগুলোতে এ ধরনের ধাতুর ব্যবহার ব্যাপক। এ ছাড়াও মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের মতো নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্যের জন্য দরকার পড়ে তামা, অ্যালুমিনিয়াম, লোহার মতো ধাতু। এগুলোও পাওয়া যেতে পারে চাঁদে। তার মানে, চাঁদ থেকে এসব মূল্যবান খনিজ সংগ্রহ করতে পারলে মিটে যাবে অনেক সমস্যা। উদাহরণ হিসেবে গত বছর ডেইলি মেইলে উদ্ধৃত অনুমানে চাঁদের জলের মূল্য $২০০ বিলিয়ন, এর হিলিয়াম $১.৫ কোয়াড্রিলিয়ন এবং এর ধাতুর মূল্য $২.৫ ট্রিলিয়ন।এই গুলি ছাড়াও, অন্যান্য খনিজগুলির মধ্যে রয়েছে বেসাল্ট, লোহা, কোয়ার্টজ, সিলিকন, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম এবং টাইটানিয়াম।

চাঁদই লাভজনক উপাদানে ভরপুর একমাত্র স্বর্গীয় বস্তু নয়। ১৬ সাইকি নামে পরিচিত একটি ১৭৩ মাইল-প্রশস্ত গ্রহাণু সোনা, লোহা এবং নিকেল দিয়ে তৈরি বলে মনে করা হয়। গ্রহাণুটির আকরিকের মূল্য প্রায় ১০ কুইন্টিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারনা সাইকিতে, ১.৭×১০১৯ কেজি নিকেল-লোহা আছে যা পৃথিবীর আগামী কয়েক মিলিয়ন বছরের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। আরেকটি গ্রহাণু, ডেভিডা, এর মূল্য $২৭ কুইন্টিলিয়ন বলে মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার গ্রহ-পদার্থবিদ ফিলিপ মেৎজগার এক পত্রিকায় বলেছেন প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিই আসলে পরীক্ষাগারে রয়েছে। তবে বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য এগুলো এখনো সেই অর্থে প্রস্তুত না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্কুল অব মাইনস স্পেস রিসোর্স প্রোগ্রামের ভূতত্ত্ব ও ভূপ্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কেভিন ক্যানন বলছেন, এ জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে।

চাঁদের জন্যও বিষয়টি মোটামুটি একই রকম। তবে বাড়তি একটা বিষয় হলো, এ জন্য আগে কলোনি বা কিছু অবকাঠামো অন্তত লাগবে। কারণ, হিলিয়াম-৩ যেমন, সংগ্রহ করে সরাসরি পৃথিবীতে নিয়ে আসা যাবে না। একে গ্যাসে রূপান্তর করে, কন্টেইনারে করে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য নাসা ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকনকে (ICON) নাসা ইতিমধ্যেই চাঁদে নিয়মিত অবতরণের জন্য ল্যান্ডিং প্যাড ও সড়ক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নির্মাণের জন্য ফান্ড বা অর্থায়ন করেছে।

চাঁদ এবং গ্রহাণুতে খনিজগুলির জন্য প্রতিযোগিতা Race for Resources মহাকাশ সম্পদের অন্বেষণের এক নতুন দিক। এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ পর্যায়ে তাই সংশ্লিষ্ট আইনগুলো নিয়ে বারবার কথা আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপি স্কুল অব ল’র মহাকাশ আইনের অধ্যাপক মাইকেন হ্যানন বলছেন, ‘আউটার স্পেস ট্রিটি এখন সময়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।’যদিও বর্তমানে বিভিন্ন দেশগুলি চেষ্টা করছে মিলেমিশে সমঝোতায় আসতে। তবে যেখানে নগদ নারায়ণ উপস্থিত, সেখানে সমঝোতায় যাওয়া একটু কঠিনই বটে ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোট গঠনের বৈঠকে অংশ নিতে পারে ৩২টি দল

উত্তরাপথ: আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিরোধী জোট গঠনের জন্য বেঙ্গালুরুতে আগামী ১৭-১৮ জুলাই বিরোধী দলগুলির সমাবেশ হতে চলেছে। এই বৈঠকে ২৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেবে বলে জানা গেছে। সূত্রের খবর, এবার বিরোধী দলে যোগ দিতে যাচ্ছে আরও নতুন ৮টি দল। এই দলগুলি হল, মারুমালারচি দ্রাবিড় মুনেন্দ্র কাজগাম, কঙ্গু দেস মক্কাল কাচ্চি, বিদুথালা চিরুথাইগাল কাচ্চি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ, কেরালা কংগ্রেস জোসেফ, কেরালা কংগ্রেস মানি ।তবে বিরোধী জোটে যদি সব গুলি দল .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top